ইমামুল ইসলামের ছোটগল্প ”দুপুর আড়াইটা” ১ম পর্ব

লেখক:
প্রকাশ: ৫ years ago
মোহাম্মদ ইমামুল ইসলাম

দুপুর আড়াইটা (ছোটগল্প, প্রথম পার্ট)

মোহাম্মদ ইমামুল ইসলাম

প্রকৃতিতে মানুষ এক ভয়াবহ জীব। হাজারো সমস্যায় মানুষ তার গতিপথের বাঁক বদল করেনা। সহজাত প্রাপ্তির নেশা তাদেরকে ছুটন্ত ঘোড়ার মতো তাড়িত করে। কোথায় যেন এ চলিষ্ণুতার ছন্দোপতন ঘটবে তা তাদেরকে ভাবায়না। রেহান ভাবনার জগতে হাবুডুবু খায় এ সকল মনুষ্য প্রজাতিকে নিয়ে, যাদের ভাবনা শুধু প্রকৃতিকে পরাজিত করাই না, যারা প্রকৃতির কোমল ক্রোড়ে থেকে বিশ্বাসঘাতকতা করে প্রকৃতির নিয়মতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে।

রেহান বেসরকারি চাকরি করে। অসম্ভব সৃজনশীল সে কিন্তু বেসরকারি চাকরিতে তার কোনো উপযোগিতা নেই। কারণ তার মাথার উপরের পদাসনগুলিতে দৃঢ়ভাবে ঝাঁপটে ধরে আছে পদলেহনকারী সুযোগসন্ধানী কিছু লোক। যারা কখনো নিজ স্বার্থ ব্যতীত সামষ্টিক কল্যাণে অনীহা প্রকাশে সদা ব্যতিব্যস্ত।তাই রেহান তার মেধার সিঁকিভাগই ব্যবহার করতে ব্যর্থ। তবুও স্পষ্টবাদী রেহান তার নির্ধারিত কাজটুকু সুচারুভাবে করে।

করোনার এই সঙ্কটকালীন সময়ে বাসায় বসে সে তার কাজ করে। চাকরি টিকিয়ে রাখার জন্য কোনো পারিশ্রমিক ছাড়াই তার এই কাজ শ্বাসরুদ্ধকর ঘরোয়া পরিমণ্ডলে বসে করতে হয়।

রেহান ভাবে, এই করোনা-জীবাণু মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত, অসহায় দিনমজুর ও খেটে খাওয়া মানুষের জীবনে গলায় হাড্ডি আটকানোর মতো বড়ো অসহনীয় অবস্থা তৈরি করেছে। তারা হাড্ডি না পারছে গিলতে, না পারছে বের করতে। রেহানের ফার্ম অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী ও প্রতিবছর লম্বা প্রফিট হাতিয়ে নিয়ে গায়ে-গতরে রিষ্টপুষ্ট হয়ে জাতীয় স্বীকৃতিও অর্জন করেছে। তবুও যাদের মেধা, ঘাম ও শ্রম ফার্মটিকে রিষ্টপুষ্ট করতে নিয়ামক ভূমিকা পালন করছে, তারা আজ এই পৃথিবী নামক বদ্ধ জেলখানায় মহাচিন্তায় আতঙ্কগ্রস্ত। রিষ্টপুষ্ট পুঁজিবাদীদের ভবিষ্য ঐতিহ্য রক্ষণে, অন্যায্য পুঁজির সংক্রমণ সাধারণ কর্মীদেরকে দিনদিন মানসিকভাবে আক্রান্ত করছে। দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ কর্মীরা পরিচর্যা করে পুঁজির যে থলেটি গায়ে-গতরে নাদুসনুদুস করেছে, সেখান থেকে আজ তারা শুধু বঞ্চিতই হচ্ছেনা বরং ওদিকে নজর দেওয়া মানে মহাপাপের শামিল। ফার্মটির মহারথী বেতন পরিশোধের অপরাগতার নির্দেশটি এক এক করে জানিয়ে দিয়েছেন। সকলকে সামষ্টিকভাবে না জানিয়ে আলাদাভাবে জানিয়েছেন এবং পৃথকভাবে সবার কাছ থেকে লিখিত প্রতিশ্রুতি নিয়েছেন। যাতে করে মহারথীর অর্জিত জাতীয় স্বীকৃতির সীলমোহরে কোনোরকম গোমূত্রের ফোঁটা তার বাহ্যিক দুধেল শুভ্র চরিত্রকে অপবিত্র না করে। ভিতরের অসুরটিকে ভিতরে আটকিয়ে রাখার কৌশল হিসেবে সে তার চারপাশে কিছু পদলেহনকারী দ্বারা কৃত্রিম পরিবেষ্টনী তৈরি করেছে যাতে করে মহারথীর সংক্রামকীয় দুর্গন্ধ আশেপাশের গণমাধ্যমের নাসিকারন্দ্রে পৌঁছে।

মোহাম্মদ ইমামুল ইসলাম

মোহাম্মদ ইমামুল ইসলাম

রেহানের ফার্মটির মহারথী ধর্মীয় সারমন দিয়ে তার কর্মীদের দুর্দশা লাঘবের মিথ্যা আশ্বাস দেয়। মহারথী বলে, “এই দুঃসময়ে তোমরা ঈশ্বরের উপরে বিশ্বাস হারাইওনা, আমার উপর আস্থা রাখা মানে ঈশ্বরের উপর আস্থা হারানো, করোনা বিশ্বাসীদের জন্য একটা পরীক্ষা, এ দ্বারা ঈশ্বর তোমাদের বিশ্বাসের খাঁটিত্ব যাছাই করেন। ঈশ্বরের উপর আস্থা রাখো, তিনি এই স্বর্গীয় সৈন্য প্রেরণ করেছেন অবিশ্বাসীদের সমুচিত শাস্তি দিতে আর বিশ্বাসীদের বিশ্বাসের পরিক্ষা নিতে।” রেহান মহারথীর সারমন শুনে কিছুটা বিরক্ত হয় কারণ যে মুখে এ উপদেশমালা শুনলো, সেই একই মুখ দ্বারা পরনারীদের মুখে অবৈধভাবে চুমু খেতে দেখেছে সে। অন্যের ব্যবসা কীভাবে হাতিয়ে নিয়ে নিজনামে কুক্ষিগত করা যায় তাও দেখেছে। কর্মীদেরকে যে সকল সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্য তা থেকে তারা বঞ্চিত হয় মহারথীর এ পবিত্র মুখের নির্দেশে। রেহান মিচকি মিচকি হাসে আর মনে মনে বলে, “এ যেন ভূতের মুখে রাম রাম নাম।”
রেহানের বাসায় রেহান ও তার স্ত্রী থাকে। ভাড়া বাসায় স্ত্রীসহ বসবাস করছে আর অসহায়ত্বের দিনগুলি গুনছে। রেহানের স্ত্রী রোজালিন অসম্ভব হিসেবী প্রকৃতির মানুষ, রেহানের মাসিক বেতনকে কুটিকুটি করে কর্তন করে কর্তিত অংশগুলোকে সংসারের বিভিন্ন খরচের জন্য ব্যয় করে। কিন্তু করোনা সঙ্কটকালীন এই দুঃসময়ে সংসারের চাকাটা সচল রাখার জন্য বেচারীর অনেক বেগ পোহাতে হচ্ছে। করোনা ভাইরাসের মহামারির আগে স্বামীর ভালোলাগার উপর গুরুত্ব দিয়ে রান্নাবান্নার মেন্যু নির্ধারণ করতো। দুপুরে অফিসে খাওয়া-দাওয়া করতো বলে রাতের খাবারটা রেহানের পছন্দের মেন্যু দিয়ে সজ্জিত রাখতো।
যদিও মেন্যুতে দু’য়ের অধিক আইটেম রাখতোনা। তাছাড়া ভবিষ্যত প্রজন্মের ‘ দুধেভাতে’র ভাবনাও তাকে কিছুটা মিতব্যয়ী হতে বাধ্য করেছে। কিন্তু ঘুরেফিরে এখন আর জীবন চলতে চাচ্ছেনা। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য মজুদকৃত ক্ষুদ্র সঞ্জয়ের উপর অনিচ্ছুক হাতটি বাড়িয়ে দিতে হলো রোজালিনকে। বাড়িভাড়া দিতে হচ্ছে প্রতি মাসে কারণ মধ্যবিত্তের আত্মমর্যাদাবোধের ভোতা অহমটিকে টিকিয়ে রাখতে এ কাজটি করতে হচ্ছে তাকে। রোজালিন রেহানের প্রিয় খাবার এখন আর রান্না করতে পারছেনা। দুপুরে আলুভর্তা ও ডাল এবং রাতে ডিমভাজি ও ডাল এমন সাদামাটা মেন্যু দিয়ে প্রায় মাস তিনেক চালিয়ে নিচ্ছে। রেহান রোজালিনের দৈনন্দিন কাজ স্বচক্ষে দেখছে এই প্রথম। কারণ এর আগে রেহান অফিসের ব্যস্ততায় সংসারের খুঁটিনাটিতে মনোযোগ দেয়া হতোনা।
এখন বাসায় বদ্ধজীবনে থেকে রোজালিনের কাজকর্মে কিছুটা দৃষ্টি নিক্ষিপ্ত হয়।রেহান রোজালিনকে বলে, “তোমার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বপ্নগুলোর মধ্যে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়েছে। কিন্তু এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বপ্নগুলোকে সংক্রমণমুক্ত করার প্রতিষেধক তৈরিতে এখনো সরকার সফলতা অর্জন করেনি। তারা পুঁজিপতিদের পুঁজির নিরাপত্তার জন্য বিশেষ অনুদান নিয়ে সদা জাগ্রত।সরকারের শক্ত কোনো নির্দেশনা নেই ঐ সকল পুঁজিপতিদের প্রতি যাদের অধীনে বিপুলসংখ্যক মানুষ তাদের মেধা, ঘাম ও শ্রম দিয়ে কাজ করে এবং পুঁজিপতি তৈরি করে।” রোজালিন রেহানকে তার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বপ্নগুলির কথা মনে করিয়ে বলে,”ইচ্ছে ছিল সামনের জানুয়ারিতে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য কাঙ্ক্ষিত রসায়নে যাব আমরা দু’জনে।ছোট একটা তারা আমার স্বপ্নাকাশে উদিত হয়েছিল কিন্তু সে তারাটি করোনার কুনজর লেগে খসে পড়লো।”