মোহাম্মদ ইমামুল ইসলাম
দুপুর আড়াইটা (ছোটগল্প, দ্বিতীয় পার্ট)
মোহাম্মদ ইমামুল ইসলাম
করোনা সঙ্কটকালীন সময়ে রেহান তার প্রিয় বন্ধু জিয়ান ও প্রদীপের সাথে ফেসবুকীয় আলাপচারিতার মাধ্যমে বন্ধুত্বের রসায়নটিকে আরো গাঢ় করে। করোনা মহামারীর পূর্বে তাদের সাথে মাঝেমাঝে কথা হতো। এখন তা প্রায় দৈনন্দিন জীবনে করোনার মতো কোনো অভিপ্রায় ছাড়াই ঢুকে পড়েছে।আলাপচারিতায় উঠে আসে করোনাকালীন সময়ে রাষ্ট্রীয় নীতির কার্যকারিতা ও ফলপ্রসূতা, সাধারণ জনগণের কান্ডজ্ঞানহীন আচরণ, অসহায় মানুষের জন্য বরাদ্দকৃত চাল চুরির অভিযোগ, মন্ত্রণালয়েগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা, মন্ত্রীদের বেফাঁস মন্তব্য, করোনাযোদ্ধা হিসেবে ডাক্তার, নার্স, পুলিশ প্রশাসন , স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা, গার্মেন্টস মালিকদের দ্বিচারিতা এবং করোনার টেস্ট কীট নিয়ে ওষুধ প্রশাসন ও ডাক্তার জাফরুল্লাহ মধ্যে টানাপোড়ন-এসব নিয়ে চুলছেড়া বিশ্লেষণ করাই জিয়ানের মূল বিষয়।
ধূমপায়ী জিয়ান প্রায় আড়াই মাস পর্যন্ত সিগারেটের পাছায় সুখটান দিয়ে নিজের আসক্তির তেষ্টা মেটাতে পারছেনা। অপরদিকে প্রদীপ তার স্টকে পর্যাপ্ত সুখটানের কাঠি সরবরাহ করে রেখেছে। যদিও তার বাবা পুত্রধনের এহেন কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবগত নন। তরে সে তার মা’য়ের নজর এড়িয়ে যেতে পারেনি। বাসার ছাদে গিয়ে কিংবা নিজ কক্ষের ছিটকানি লাগিয়ে সিগারেটের পাছায় সুখটান দিয়ে ভিতরের ফুসফুসটাকে ধূম্রকুঞ্জ দ্বারা আক্রান্ত করে। কক্ষে সিগারেট শলাকার দুর্গন্ধ নির্বাপিত করার জন্য সে সুগন্ধযুক্ত বাষ্পীয় ফসফস ছেড়ে দেয়। যাতে বাসায় কেউ তার এহেন বদাভ্যাসটি আঁচ করতে না পারে।জিয়ান-প্রদীপের ধূমপান তাদের মেধার কার্যকারিতা সচল হয় বলে তারা দাবি করে। যদিও জিয়ানের আড়াই মাসের ধূমপান বিরতি তার চেহারায় অনেকটা কমনীয়তা বৃদ্ধি করেছে।
জিয়ান ও প্রদীপ দুজন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে। জিয়ান যন্ত্রবিজ্ঞানের আর প্রদীপ বিধিশাস্ত্রের শিক্ষক। জিয়ান আলাপে বলে, “আমরা দুজনেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষাকার্যক্রম সুচারুভাবে অনলাইনে অব্যাহত রাখি। শিক্ষকতার পাশাপাশি এই ক্রান্তিলগ্নে ছাত্রছাত্রীদের পাশে থেকে করোনা মহামারি মোকাবেলার পরামর্শ দিয়ে থাকি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের নিধিরাম সর্দারেরা ছাত্রছাত্রীদের অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রমে অংশগ্রহণ করার জন্য কোনো ধরনের তথ্য আনুষ্ঠানিকভাবে দেয়নি।” প্রদীপও রেহানকে জানায় তাদের যৌথ আলাপচারিতায়,” আমরা স্বপ্রণোদিত হয়ে ছাত্রছাত্রীদের অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে যথেষ্ট উৎসাহিত করেছি। সবধরণের তাজা তথ্য প্রদান করে তাদের উৎকন্ঠা, অনীহা,দ্বান্দ্বিকতা ও উদ্বিগ্নতা দূর করতে সচেষ্ট থাকি।
কিন্তু নিধিরাম সর্দারদের যৌক্তিক সিদ্ধান্তগ্রহণের শম্ভুকগতি ছাত্রছাত্রীদের দ্বিধাদ্বন্দ্ব লঘুকরণে যথেষ্ট অন্তরায় হিসেবে কাজ করেছে।”রেহান, জিয়ান ও প্রদীপের মাঝে কিছুটা অন্তমিল আছে। মতাদর্শিক ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও তারা চাটুকারী, পদলেহনকারী, বিবেকহীন, নৈতিকতা ও বাস্তবতা বিবর্জিত স্বার্থবাদীদের পরিমণ্ডল এড়িয়ে চলে। জীবনের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলি যাদের মনোজাগতিক কেন্দ্রে বিবেকের তাড়নাঘাত ও নৈতিকতার কম্পন তৈরি করেনা তাদেরকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করে তারা। জিয়ান ও প্রদীপ ছাত্রছাত্রীদের উন্নত মানসিকতা বিনির্মাণে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। কোনো এক অনলাইন ক্লাসে প্রদীপ ছাত্রছাত্রীদেরকে বলে, “পশ্চিমা বিশ্বে বলেনা আমার স্ত্রী গর্ভবতী, বলে আমরা গর্ভবতী, আমরা নতুন অতিথির জন্য অপেক্ষা করছি (My wife is not pregnant. We are pregnant and waiting for a new guest.)। এমন সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলি ছাত্রছাত্রীদের মনোজাগতিক কেন্দ্রের শূন্য গহ্বরে ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে।
জিয়ান ভাইরাসটির গতি-প্রকৃতি আলাপচারিতায় তার বন্ধুদ্বয়কে বলে, “করোনার জীবাণু পোষক দেহে বেঁচে থাকে শুধু পোষক দেহের রোগ-প্রতিরোধের চক্রটিকে অকার্যকর করার লক্ষ্যে।চক্রটি অকার্যকর করতে পারলে, জীবাণুটি তার বীরত্ব প্রকাশ করে পোষকদেহের মৃত্যু নিশ্চিত করে এবং জীবাণুটি তার আত্মোৎসর্গের পথ প্রশস্ত ফেলে।কারণ জীবাণুটির জীবন্ত পোষকদেহ দরকার বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে।” জিহানের আলাপে রেহান সংযুক্ত করে,” জ্যামিতিকহারে বৃদ্ধি পাওয়া এ অকোষীয় আণুবিক্ষণিক ভাইরাসটির ক্ষমতার দম্ভ আন্তর্জাতিক পরাশক্তির কাঠামোতে আঘাত হেনেছে। পরাশক্তির রাষ্ট্রগুলো এখন অস্ত্রব্যবসা বাদ দিয়ে ভাইরাস-ব্যবসায় বিনিয়োগে মনোযোগী হতে পারে। এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায়না।” প্রদীপ ভাইরাসটির সহজাত স্বার্থবাদী চরিত্র বিশ্লেষণ করে বলে,” ভাইরাসটি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল পরিভ্রমণ করে নিজ চরিত্রের স্বকীয়তা হারিয়েছে। নতুন পরিমণ্ডলে নতুনভাবে খাপ খাওয়াতে পারে ভাইরাসটি।গিরগিটির মতো ভাইরাসটি, ব্যক্তিক, স্থানিক, দেশজ ও বিশ্বমাত্রিক।ভাইরাসটি সংক্রামিত ব্যক্তির মত ব্যক্তিক।আঞ্চলিক পরিমণ্ডলে স্থানীয় ভূমিকা পালন করে, দেশীয় পরিমণ্ডলে উক্ত দেশের জনগণ ও শাসকশ্রেণীর চরিত্র প্রতিফলিত হয় ভাইরাসটির সহজাত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে। আর বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে ভাইরাসটি বিশ্বমহারথীর ভূমিকা পালন করছে। তবে ব্যক্তিক অবয়বে ভাইরাসটি সঙ্কীর্ণতার হুঙ্কার দেয় যেমন আমাদের চারপাশে সঙ্কীর্ণ অবয়বগুলো হা হু হুঙ্কার তুলে।”
রেহান ওদেরকে বলে, “ভাইরাসটি তার সহজাত বৈশিষ্ট্য দ্বারা ‘যেই লাউ সেই কদু’র শিক্ষা ব্যতীত অন্য কোনো আত্মোসংশোধনের দীক্ষা দেয়নি।ভাইরাসটি ধর্মতন্ত্রের ধারক ও বাহকদের অনুর্বর মস্তিষ্কে অবৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যা (বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার ভান করে) তৈরিতে বহু রসদ যোগান দিয়েছে। সামাজিক দূরত্ব লঙ্ঘন করে স্থানীয় ধর্মীয় মহারথীরা গণজমায়েত করেছে করোনা নামক ঈশ্বরের সৈনিকের হুমকি উপেক্ষা করে।”
রেহান সবসময় ইতিবাচক চিন্তাভাবনা দ্বারা সংক্রমিত। কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে করোনা জীবাণুর ইতিবাচক উপস্থিতি তার চিন্তার মধ্যে নেতিবাচক চিন্তার জীবাণু ঢুকিয়ে দিয়েছে। কোরোনা মহামারির (আনন্দবাজার পত্রিকা বলে অতিমারি) শুরুতে দেশজ ও বৈশ্বিক পরিস্থিতি ইন্টারনেটে মেগাবাইট খরচ করে জেনে নিত। ইউরোপীয় দেশগুলোর করুন দশা তাকে খুব ব্যথিত করতো। আর মাঝেমাঝে অতিধার্মিকদের প্রতিহিংসামূলক ফেসবুকীয় মন্তব্য তার মানবতন্ত্রের জীবনাদর্শে আন্তঃজ্বলন শুরু করে দিত।
যখন বঙ্গীয় ভূখণ্ডে আক্রান্তের সংখ্যা জ্যামিতিকহারে বাড়ছে, ঠিক তখনই চোখের দৃষ্টি যায় সময় (দু’টি ঘটনার মধ্যবর্তী একক’কে সময় বলে) পরিমাপক যন্ত্রের দিকে। দুপুর আড়াইটার টুংটাং শব্দ কেমন যেন মৃত্যুঘন্টা নিয়ে হাজির হয়। আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যুসংখ্যার অনুপাত পরিক্ষা-নিরীক্ষা করে মহামারির গতি-প্রকৃতি বুঝার চেষ্টা করে। কোনোদিন যদি আক্রান্তসংখ্যা ও মৃত্যুসংখ্যার অনুপাত একটু কম হয়, তখন রেহানের কাছে আশার চেরাগটি খুবই আলোকিত মনে হয়। কিন্তু পরের দিনের ঊর্ধগতির অনুপাতটি তার এ চেরাগটির উজ্জ্বল আলোকটি নিভিয়ে দিয়ে যায়। এ অনিশ্চিত জ্বলানেভার মাঝে জীবন-জীবিকার রূঢ় পথ সচল হলো করোনার তীব্র হুঙ্কারকে উপেক্ষা করে। রেহান মনে মনে ভাবে, “দুপুর আড়াইটা, তুমি শুধু সংখ্যাতান্ত্রিক তথ্যপ্রদান সময়ের একক নও, তুমি নিশ্চয়তা-অনিশ্চয়তার একক, বাঁচা-মরার একক, বিবেক-বিবেকহীনতার একক, সচেতনতা-অসচেতনতার একক, আশা-নিরাশার একক এবং চিন্তা-দুশ্চিন্তার একক।” আগামিকাল দুপুর আড়াইটায় এ এককগুলির কোন এককটি টুংটাং ঘন্টা বাঁজাবে তার অপেক্ষায় থাকে রেহান। এভাবে কতদিন আসবে দুপুর আড়াইটা তা তার জানা নাই।