বসন্তের রুক্ষতায় যখন পাতাশূন্য হচ্ছে প্রকৃতি, ঠিক তখনি মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে পলাশ ও শিমুল ফুল। গ্রামীণ আবহে হরহামেশাই রাস্তের ধারে দেখা মিলবে ফুল গাছ দুটির। কিন্ত কংক্রিটের শহুরে জীবনে যার দেখা মেলা কষ্টস্বাধ্য বটে। তবে দিনের পরিক্রমায় গ্রামীণ আবহ থেকেও হারিয়ে যাচ্ছে গাছগুলো। কিন্তু ভিন্ন চিত্রের দেখা মিলবে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে।
১৭৫ একরের ক্যাম্পাসে বহুগুনে মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে পলাশ আর শিমুল ফুল। ক্যাম্পাসের প্রশাসন ভবন, মীর মোশাররফ হোসেন অনুষদ ভবন ও রবীন্দ্র-নজরুল কলা ভবনের চারপাশে দেখা মিলবে পলাশ ফুল গাছের। ক্যাম্পাসজুড়ে প্রায় ১৫টি পলাশ ফুলের গাছ রয়েছে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুটবল মাঠ, লেক ও বঙ্গবন্ধু হলের পিছনে রক্তিম আভার মতো মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে শিমুল ফুল।
সম্মুখে চওড়া পাপড়ি, পেছনে দুটি ডানার মত ছড়ানো এবং দুটি একত্রে বাঁকানো, পাখির ঠোঁটের মতো অরণ্যের অগ্নিশিখা পলাশ। যেন পহেলা ফাল্গুনের আগাম বার্তা দিয়ে যায়। পলাশের সমারোহে ইঙ্গিত দেয় পলাশ যেন বসন্তেরই পূর্ণতা। এটির বৈজ্ঞানিক নাম (Butea monosperma)। তবে পলাশ নামেই পরিচিতি বেশি। রয়েছে আরো কত বাহারী রকমের নাম যেমন কিংশুক, পলাশক, বিপর্ণক। বাংলা সাহিত্যে পলাশের প্রভাব অতিশয়। গানে, কবিতায় কোথায় নেই পলাশ? তবে শুধু এ কালের সাহিত্য নয়, পলাশ সুপ্রাচীনকালেও ছিল সমান আদরণীয়। মহাভারতের সভাপর্বে ইন্দ্রপ্রস্থ নগরের যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, সেখানে উদ্যান আর কৃত্রিম জলাধারের পাশেও ছিল পলাশ বৃক্ষের মাতামাতি।
পলাশ ও শিমুলের নয়ানাভিরাম সৌন্দর্য মন কেড়েছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের। তার প্রমাণ মিলছে গাছগুলোর চারপাশে। প্রিয়তমার হাতে শোভা পাচ্ছে গাছ থেকে ঝরে পড়া পলাশ আর শিমুল ফুল। কেউবা আবার ক্যামেরায় ফ্রেমবন্দী করতে ব্যস্ত।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ ইমন বলেন, ছোটবেলার খেলা সঙ্গী ছিল পলাশ ফুল। সময়ের সাথে গ্রামেও গাছগুলোর দেখা মিলে না। কিন্তু ক্যাম্পাসে গাছগুলোর উপস্থিতি আমাকে আন্দোলিত ও মুগ্ধ করে। ফুলগুলো দেখলেই ছোটবেলার স্মৃতিতে ডুব মারতে বাধ্য হই। এ যেন প্রাণের স্পন্দন।
পলাশের মুগ্ধতার বিষয়ে রবীন্দ্র গবেষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক ড. সরওয়ার মুর্শেদ বলেন, কলা অনুষদের ডিন থাকা অবস্থায় আমি একটি বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি গ্রহণ করি। যার আওতায় অনুষদ ভবন ও রবীন্দ্র-নজরুল কলা ভবনের চারপাশে ৫০টির মতো পলাশ ফুলের গাছ রোপণ করা হয়। এবছর পাঁচটি গাছে পলাশ ফুল ফুটেছে। যা আমাকে উচ্ছ্বসিত ও উদ্বেলিত করেছে। মূলত প্রকৃতি মানুষের হৃদয়কে খুব সহজে জয় করতে পারে। সাহিত্যিকরা তাই প্রকৃতির প্রেমে পড়েছেন বারংবার। এ বর্ষায় ক্যাম্পাসে আরও কিছু শিমুল ও পলাশ গাছ লাগানোর পরিকল্পনা আছে। তিনি আরো বলেন, এ গাছগুলো আমার সন্তানের মতো।
পলাশের মতো ফাল্গুন মাসজুড়ে শিমুল ফুল লাল পাপড়ি মেলে সৌন্দর্য বিলাচ্ছে। দূর থেকে হঠাৎ দেখলে ঠিক মনে হবে, কেউ লাল গালিচা বিছিয়ে রেখেছেন। গাছজুড়ে টকটকে লাল শিমুল ফুল। ফুলের সুবাস না থাকলেও সৌন্দর্যে মুগ্ধ হন না, এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। রাস্তার পাশে শিমুল ফুলের সৌন্দর্য দেখে অবশ্যই প্রকৃতিপ্রেমীদের নজর কাড়বে। পাখপাখালি আর মৌমাছিদের আনাগোনা চোখে পড়ার মতো দৃশ্য। ফাগুনের আগুন মানেই যেন শিমুল ফুল। যুগে যুগে শিমুল ফুল নিয়ে গান, গল্প, কবিতা লিখেছেন অনেক সাহিত্যিক। বাংলাদেশে এমন কোনো অঞ্চল নেই যেখানে শিমুল ফুলের দেখা মেলে না।
শিমুল আমাদের অত্যন্ত পরিচিত একটি ফুল। তাই শিমুল শব্দটা উচ্চারণ করলে সবার আগে এর রক্তরাঙা চেহারার কথাই মনে আসে। শিমুলের ইংরেজি নাম: Silk Cotton Tree। বাংলা নাম: শিমুল, রক্ত শিমুল, লাল শিমুল। বৈজ্ঞানিক নাম: B.ceiba। Bombax গণের অন্তর্গত পাতাঝরা বৃক্ষ জাতীয় তুলা উৎপাদক উদ্ভিদ। লম্বায় প্রায় ১৫-২০ মিটার হয়। এর শাখা-প্রশাখা অপেক্ষাকৃত কম। সরল ও বৃত্তাকারভাবে চারদিকে বিস্তৃত। বাকলে কাঁটা থাকে। পাতার গঠন অনেকটা বোঁটায় ছড়ানো হাতের পাঞ্জার মতো। এর পাতা ৭ থেকে ১১ সেন্টিমিটার চওড়া হয়। শীতের শেষে এই গাছের পাতা ঝরে যায়। ফাল্গুন মাসে ফুলের কুঁড়ি আসে এবং চৈত্র মাসে বড় এবং উজ্জ্বল রঙের লাল ফুল ফোটে। এরপর গাছের পাতা গজানো শুরু হয়। ফুলের পাপড়ি ১০ থেকে ১২ সেন্টিমিটার লম্বা হয়। এর পুংকেশের অনেক থাকে। এর স্ত্রীকেশর পুংকেশর অপেক্ষা লম্বায় বড় হয়। এর মোচাকৃতি ফল হয় এবং বৈশাখ মাসে ফল পাকে এবং ফল ফেটে বীজ ও তুলা বের হয়ে আসে। বীজের রং কালো। শিমুল তুলা লেপ, তোশক ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এগুলো হলো রেশমি শিমুল, লাল শিমুল, কাপোক শিমুল, পাহাড়ি শিমুল, মোজাম্বিক শিমুল। শিমুল বহুবর্ষজীবী বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদ। বাংলার মাঠে-ঘাটে, রাস্তার পাশে অনাদর-অবহেলায় বেড়ে ওঠে শিমুলগাছ। সাধারণত বর্ষাকালে পানি পেলে জন্মায়। দ্রুত বর্ধনশীল গাছ। মাত্র ৪ থেকে ৫ বছরের মধ্যে উচ্চতায় আশপাশের আম-কাঁঠাল জাতীয় ২০ থেকে ২৫ বছরের পূর্ণবয়স্ক বৃক্ষকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। বছরে ছয় মাস সবুজ পাতায় সুশোভিত থাকে শিমুলগাছ।