ইউরোপ মাতাচ্ছে বরিশালে তৈরি জুতা

লেখক:
প্রকাশ: ৪ years ago

২০১২ সাল শেষ হবে হবে করছে। ডিসেম্বরের ৪ তারিখ বরিশাল বিসিক শিল্প নগরীতে যাত্রা শুরু করলো একটি জুতা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা আর দক্ষ শ্রমিকের অভাব দুইয়ে মিলে বেশ যাতনা পোহাতে হয় উদ্যোক্তাকে। প্রায় আট বছর হতে চললো, কঠিন দুই চ্যালেঞ্জই মোকাবিলা করে দেশের গন্ডি পেরিয়ে এখন ইউরোপের বাজারে বেশ চাহিদা করে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এতে একদিকে যেমন দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আসছে, অন্যদিকে স্বাবলম্বী হচ্ছেন বরিশাল অঞ্চলের অবহেলিত-নির্যাতিত নারীরা।

বলছিলাম ‘ফরচুন সু কোম্পানি’র কথা। বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ পার করে সফল হতে চলা প্রতিষ্ঠানটি এখন দৈনিক জুতা উৎপাদন করে যাচ্ছে ২২ হাজার ৫০০ জোড়া পর্যন্ত। আর এতে কাজ করছেন সাড়ে ৪ হাজার শ্রমিক; যাদের প্রায় ৮০ ভাগই নারী।

প্রতিষ্ঠানটি বলছে, বরিশাল বিসিক শিল্প নগরীর ৫৮ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম কোন কোম্পানি এত পরিমাণ জুতা রফতানি করছে। উন্নত মানের এসব জুতার বেশ চাহিদা বাড়ছে ইউরোপের দেশ জার্মানি, স্পেন, বেলজিয়াম, পোল্যান্ড ও ফ্রান্সসহ উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে। অবশ্য এসব জুতার কাঁচামালও আমদানি করতে হচ্ছে চীন, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান ও প্রতিবেশী ভারত থেকে।

প্রতিষ্ঠানটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১২ সালের ৪ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে এই সু কোম্পানিটি। প্রথম অবস্থায় ৪৭২ জন লোকবল নিয়ে বরিশাল বিসিক নগরীর ২টি প্লটে কারখানা খুলে সু প্রস্তুতের কার্যাক্রম শুরু করে। এরই মধ্যে উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ২০২১ এর শেষের দিকে আরও চারটি প্রোডাকশন লাইন সংযুক্ত করে মোট ছয়টি লাইন করার পরিকল্পনা রয়েছে।

কোম্পানি কর্তৃপক্ষ বলছে, এসব জুতার আকৃতি, গঠন ও গুণগত মান দেশের অন্য যে কোন ব্র্যান্ডের জুতার চেয়ে উন্নত। ফরচুন পণ্য তৈরিতে ক্রেতা সন্তুষ্টির বিষয়ে কখনোই কোনো আপস করে না। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মো. মিজানুর রহমান তার দূরদর্শীতায় ফরচুন স্যুজ লিমিটেডকে পরিবেশ বান্ধব কোম্পানি হিসেবে গড়ে তুলেছেন এবং ফরচুনকে তিনি বাংলাদেশের অন্যতম সেরা কোম্পানি হিসেবে রূপান্তর করেছেন।

বেশ ঝকঝকে ও পরিচ্ছন্ন কোম্পানিটির কাজের পরিবেশও নিরাপদ বলছেন এখানকার শ্রমিকরাই। তারা বলেছেন, ফরচুন আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে রফতানির জন্য নারী, পুরুষ, ও শিশুদের জন্য বিভিন্ন স্টাইলের স্যু’জ, ফ্যশন্যাবল স্যু’জ ও স্পোর্টস স্যুজ উৎপাদন করে থাকে।

কথা হয় প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানের সঙ্গে। তিনি জানান, বরিশাল থেকে সরাসরি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জুতা রফতানির জন্য ১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রতিষ্ঠানটির কারখানা নির্মাণ করেছেন তিনি। তার প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে মান সম্মত জুতা তৈরি। এই লক্ষ্যে তিনি কারখানার জন্য উন্নত ধরনের যন্ত্রপাতি এনেছে চীন থেকে।

বন্দরনগরী চট্টগ্রামে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও বরিশাল বিসিক শিল্প নগরীতে কারখানা স্থাপন করেছেন মিজানুর রহমান। এর কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, তার জন্মস্থান বরিশালে। এ অঞ্চলের মানুষের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি করতেই বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও তিনি বরিশালেই কারখানা গড়ে তুলেছেন। বিশেষ করে বরিশাল থেকে ফ্লাইট চলাচল বন্ধ থাকায় বেশ বিপাকে পড়তে হয়েছিলো তাকে। একবার নাকি জাপানের ক্রেতারা কার্যাদেশ দেয়ার জন্য পরিদর্শনে আসার কথা বলে পরে নাকচ করে দিয়েছিলেন এই কারণে। তবে বর্তমানে সারা বিশ্ব থেকে অর্ডার পাচ্ছে এই কোম্পানি।

বর্তমানে কারখানায় ৫ হাজারেরও বেশী শ্রমিক প্রতিদিন ২২ হাজার ৫০০ জোড়া জুতা তৈরি করেন। প্রথম অবস্থা বিসিক থেকে দুইটি প্লট নিলেও পরে আরো ৩টি প্লট বরাদ্দ নেয় এই সু কোম্পানি। এ ছাড়া আরো ছোট ছোট ৫টি প্লট বরাদ্দ নিয়ে সু-কোম্পানি তার কার্যক্রম আরা বিস্তৃতি ঘটায়। জুতা তৈরির কাজের সুবিধার্থে মিজানুর রহমান আরো প্রতিষ্ঠা করেছেন ফোম ফ্যাক্টরি, ল্যামেনিশন ফ্যাক্টরি, কাটিং ডিভাইস, কার্টুন, ইনআর বক্স ও অ্যাব্রয়ডারি ফ্যাক্টরি।

এছাড়ার জুতা তৈরিতে বৈচিত্র্য আনতে মিজানুর রহমান এই বিসিক এলাকাতেই প্রতিষ্ঠা করেছেন আরো দুটি  সু-ফ্যাক্টরি। এম জে ইন্ডাস্ট্রিস ও প্রিমিয়ার ফুটওয়্যার লিমিটেড নামের এই প্রতিষ্ঠান দুটিরও জুতা নিজস্ব ল্যাব সেকশনের মাধ্যমে পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়ে থাকে বলে জানান তিনি।

ফরচুন বিশ্বের বিখ্যাত ব্রান্ডের জন্য স্যু’জ তৈরি করে থাকে। এর মধ্যে DIECHMANN, FILA, SLAZENGER, CCC, GEMO, MARKEL, UMBRO, AIRNESS, STEVE MADDEN, EURO SHOES, DUNLOP, REDTAPE, LIDL, BOND STREET, CORTINAGesPRIMARK  ব্র্যান্ডের জুতা তৈরি হচ্ছে ফরচুনের কারখানায়।

কোম্পানিটিতে রয়েছে আধুনিক ইনজেকশন মোল্ডিং মেশিন এবং টেস্টিং ল্যাব যেখানে আধুনিক প্রযুক্তির আউটসোল ফ্লেক্সিং নিরীক্ষা, স্যোল বন্ডিং ও পুল ফোর্স নিরীক্ষা সুবিধাও রয়েছে। কোম্পানি চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, যোগ্য ও দক্ষ লোককে উপযুক্ত পদে স্থলাভিষিক্ত করে প্রতিষ্ঠানটি আজ সাফল্য ধরে রেখেছে। ফরচুন স্যু’জ লিমিটেড আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে রফতানির জন্য মানসম্মত জুতা উৎপাদন করে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সুদৃঢ় করছে। বর্তমানে ফরচুন গ্রুপ অফ কোম্পানিজ এর বার্ষিক টার্নওভার ৫০০ কোটি টাকা।

প্রতিষ্ঠানটির মার্কেটিং ব্যবস্থাকে আরো বিস্তৃত করতে চীনের গুংঝুয়ান শহরে রয়েছে একটি কার্যালয়। সেখান থেকেই পুরো ইউরোপে এই প্রতিষ্ঠানের পণ্য সরবরাহ ও বিক্রি করা হচ্ছে। বিশেষ করে জার্মানি, স্পেন, বেলজিয়াম, পোলেন্ড ও ফ্রান্সে। এই প্রতিষ্ঠান থেকে এইচএন্ডএম, ইরাম, ইউরো সু, সিসিসি, ডনিলপ, এভারলাস্ট, লিডলসহ নানা নামি দামী প্রতিষ্ঠান সু অর্ডার দিয়ে পণ্য নিয়ে যাচ্ছেন।

এই কোম্পানিটির ৮০ ভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারী নারী। এসব নারীদের অনেকেই রয়েছেন যারা সমাজে নানাভাবে অবহেলিত। ফরচুন সু কোম্পানির শ্রমিক আয়েশা আক্তার বলেন, স্বামী সংসার সবই ছিলো। অভাবের সংসারে দুটি সন্তান নিয়ে কোন মতে কাটছিলো দিন। একদিন শুনি স্বামী পাশের গ্রামের আরেকজনকে বিয়ে করে পালিয়েছে। কী আর করার নেমে পড়লাম সংসারের খাটুনি খাটতে। অনেক জায়গায় কাজ করেছি দুই সন্তান নিয়ে খুব কষ্টে দিন কাটছিল। একদিন জানতে পারলাম ফরচুনে লোক নেয়। এসে দাঁড়ালাম চাকরির জন্য সেই থেকে আজ ৪ বছর এখানে কাজ করছি।এখানে যে বেতন পাচ্ছি তা দিয়ে সংসার ও দুই সন্তানের লেখাপড়ার খরচ দিয়ে ভালোভাবেই দিন কাটছে।

এখানে কর্মরত সাবিনা আক্তার বলেন, আমি যথেষ্ট শিক্ষিত নই এবং তাই চাকরি পাওয়ার কথা কখনও ভাবিনি, তবে সংস্থাটি আমাকে ভাল বেতনে চাকরি দেওয়ার প্রস্তাব করেছিল। তারা প্রথমে আমাদের কাজের জন্য প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। আমি এখন আমার পরিবারকে আর্থিকভাবে সহায়তা করতে পারি যা আগে আমার কল্পনার বাইরে ছিল।

রুবি আক্তার নামে আরেক শ্রমিক বলেন, আমাদের এখানে কঠোর পরিশ্রম করতে হয় না। কারণ বেশিরভাগ কাজ স্বয়ংক্রিয় মেশিন দ্বারা সম্পন্ন হয়। আমাদের কেবল মেশিনগুলি সঠিকভাবে পরিচালনা করতে হয়।

ফরচুনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, আমার সংস্থায় কর্মরত নারীরা প্রায় সবাই গৃহকর্মের সাথে জড়িত ছিলেন। তাদের আমি বরিশাল ও ঝালকাঠির বিভিন্ন উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে নিয়োগ দিয়েছি। শ্রমিকদের সহজে চলাচলের জন্য সংস্থাটি বিশেষ বাস পরিসেবা চালু করেছি। বাসগুলো সকালে তাদের উপজেলা থেকে কারখানায় নিয়ে আসে এবং সন্ধ্যায় কাজের পরে বাড়ি পৌঁছে দেয়।

এখানকার শ্রমিকদের প্রশিক্ষণকালীন সময়ে একজনের মাসিক বেতন দেয়া হয় ছয় হাজার টাকা। প্রশিক্ষণ শেষ হলে তাদের বেতন বাড়িয়ে ১০ হাজার টাকা করা হয়। চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, অনেক অভিজ্ঞ শ্রমিক এখন মাসিক বেতন পাচ্ছেন ৫০ হাজার টাকা কিংবা তারও বেশি।