বাংলাদেশের রপ্তানির সবচেয়ে বড়ো বাজার ২৭ দেশের সমন্বয়ে গঠিত ইউরোপীয় ইউনিয়ন। দেশের রপ্তানিকৃত তৈরি পোশাকের ৬০ শতাংশেরই বেশি যায় এ অঞ্চলের দেশগুলোতে। তবে সম্প্রতি ইউরোপে পোশাকের রপ্তানি কমে গেছে ব্যাপকহারে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইউরোপের বড়ো অর্থনীতির দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানে টান পড়ায় ভোগ-ব্যয়ে লাগাম পড়েছে। ফলে সার্বিকভাবে সেখানে পোশাকের চাহিদা কমতির দিকে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। ইউরোপে শীর্ষ ১০ রপ্তানিকারক দেশের তৈরি পোশাক পণ্য রপ্তানির পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত সাত মাসে সেখানে বাংলাদেশের রপ্তানি কমার হার অপেক্ষাকৃত বেশি।
এদিকে চীনের করোনা ভাইরাস ইস্যুতে নতুন করে শঙ্কা তৈরি হয়েছে গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানিকারকদের মধ্যে। রপ্তানিকৃত গার্মেন্টসের বিশেষত ওভেন পোশাকের কাঁচামালের বড়ো অংশই আসে চীন থেকে। এর বাইরে পোশাকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ধরনের এক্সেসরিজ ও কেমিক্যালের বেশিরভাগ আসে দেশটি থেকে। করোনা ভাইরাসের কারণে সম্প্রতি সেখান থেকে পণ্য পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করতে দেরি হয়েছে। কিছু বন্দর রপ্তানি কার্যক্রম শুরু করলেও তার পরিমাণ সামান্য। এ পরিস্থিতিতে রপ্তানিকারকদের মজুতেও টান পড়েছে। ফলে বিকল্প উত্স চিন্তা করতে হচ্ছে চীনের পণ্যের ওপর নির্ভরশীল রপ্তানিকারকদের। রপ্তানিকারকরা বলছেন, এরই মধ্যে স্থানীয় বাজারে ঐসব পণ্যের দাম বেড়ে গেছে।
বিকেএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ হতেম ইত্তেফাককে বলেন, রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানগুলো চীন থেকে যথাসময়ে কাঁচামালসহ অন্যান্য পণ্য না পেলে সময়মতো জাহাজিকরণ করতে ব্যর্থ হবে। সেক্ষেত্রে ১৪ গুণ বাড়তি টাকায় বিমানে পাঠাতে হবে কিংবা বায়ারকে ডিসকাউন্ট দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। অর্ডার বাতিলও হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে অনেক উদ্যোক্তার পক্ষে ব্যবসায় টিকে থাকা কঠিন হবে।
ইউরোপে বেশি ব্যবসা হারিয়েছে চীন :ইউরোপের গার্মেন্টস পণ্য আমদানির পরিসংখ্যান সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান ইউরোস্ট্যাটের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালে (জানুয়ারি-ডিসেম্বর) ইউরোপের পোশাক আমদানি কমেছে ১০৮ কোটি ৯২ লাখ মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ, যা ২০১৮ সালের তুলনায় ১ দশমিক ১০ শতাংশ কম। এ অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ চীন। পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সেখানে সবচেয়ে বেশি ব্যবসা হারিয়েছে চীন। চীনের ছেড়ে দেওয়া ব্যবসার বেশিরভাগই গেছে ভিয়েতনামসহ কয়েকটি দেশের কাছে। চীন থেকে সরে যাওয়া ব্যবসা ধরতে পারেনি বাংলাদেশ। বাংলাদেশের রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর, ১৯) ইউরোপে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি প্রায় ৬.৭৫ শতাংশ কমেছে। মুদ্রার হিসাবে যা ৭১ কোটি ডলার বা ৬ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
ইউরোপের বাজারে অন্যতম বড়ো রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ক্লাসিক ফ্যাশনস। প্রতিষ্ঠানটির মালিক তৈরি পোশাক শিল্প-মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম ইত্তেফাককে বলেন, ব্রেক্সিট (ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বের হয়ে যাওয়া) ইস্যু নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণে ইউরোপে সম্ভাব্য মন্দার আশঙ্কায় সেখানে ভোগ-ব্যয় কমেছে। ফলে ক্রেতারা দর কমিয়ে দিয়েছেন। অন্যদিকে আমাদের উত্পাদন খরচ বেড়েছে। স্থানীয় মুদ্রামানও (ডলার বা ইউরোর বিপরীতে টাকার মান) আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় পিছিয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে পণ্যের বৈচিত্র্যকরণে এগিয়ে থাকায় এ সুবিধা নিয়েছে ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান। এছাড়া বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন তথা উষ্ণায়নের কারণেও সেখানে শীতের পোশাকের চাহিদা কমতির দিকে। রপ্তানি কমতির দিকে থাকায় অনেক কারখানা মালিকের পক্ষে বর্তমানে কারখানা চালু রাখাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা যা বলেন
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ইত্তেফাককে বলেন, ইউরোপের বড়ো অর্থনীতির দেশগুলোতে গত বছর (২০১৯ সাল) প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানে শ্লথগতি ছিল। এ তালিকায় রয়েছে জার্মানি, স্পেন ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশ। এর নেতিবাচক প্রভাব সেখানকার ভোগ ব্যয়ে পড়েছে। এ কারণে সেখানে পোশাকের আমদানি কমেছে। এর প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। অন্যদিকে সেখানে সংকটের পাশাপাশি একটি সম্ভাবনা তৈরি হলেও বাংলাদেশ তা প্রত্যাশিত হারে ধরতে পারেনি। সেখানে চীনের রপ্তানি ব্যাপকহারে কমেছে। এর অর্থ হলো বড়ো রপ্তানিকারক দেশ চীন থেকে ব্যবসা সরেছে, যা ভিয়েতনাম, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলো ধরতে পারলেও বাংলাদেশ সেই সুযোগ নিতে পারেনি। এর অন্যতম কারণ হতে পারে, পণ্য বৈচিত্র্যকরণে বাংলাদেশের চাইতে আলোচ্য দেশগুলো এগিয়ে রয়েছে। মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে পণ্য বহুমুখীকরণে নজর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
ইউরোস্ট্যাটের পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা গেছে, পোশাক রপ্তানিতে গত বছর ইউরোপে চীনের পরেই দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। এছাড়া শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় রয়েছে তুরস্ক, ভারত, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান, মরক্কো, শ্রীলঙ্কা ও ইন্দোনেশিয়া। আলোচ্য সময়ে চীন ছাড়াও রপ্তানি কমার তালিকায় রয়েছে তুরস্ক, ভারত, কম্বোডিয়া, মরক্কো ও ইন্দোনেশিয়া।
ইউরোস্ট্যাটের পুরো বছরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত সাত মাসে (জুন-ডিসেম্বর) ইউরোপে বাংলাদেশের রপ্তানি কমার হার প্রতিযোগী অন্য দেশগুলোর তুলনায় বেশি। তবে ঐ সময়ে ইউরোপের বাজারে অপেক্ষাকৃত বেশি ভালো করেছে তুরস্ক ও শ্রীলঙ্কা। কিন্তু ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত পাঁচ মাসে সেখানে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ছিল পূর্বের বছরের প্রথম পাঁচ মাসের তুলনায় ৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেশি। এটি অন্যান্য প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায়ও সবচেয়ে বেশি ছিল। কিন্তু বছর শেষে তা নেমে এসেছে ২ দশমিক ৩১ শতাংশে। অন্যদিকে একই সময়ে ভিয়েতনামের ৬ দশমিক ২৪ শতাংশ থেকে নেমেছে ৪ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশে। পাকিস্তানের ৬ দশমিক ৬১ শতাংশ থেকে নেমেছে পৌনে ৫ শতাংশে। প্রথম পাঁচ মাসে চীনের রপ্তানি ৪ দশমিক ১২ শতাংশ কমেছিল, বছর শেষে তা দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ১৯ শতাংশে।
© স্বত্ব আর্থটাইমস্ ২৪.কম
প্রকাশক ও সম্পাদক: মোঃ জাকারিয়া আলম (দিপু)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ:বরিশাল-৮২০০।
আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:::
নিউজ মেইল:::
earthtimes24@gmail.com(নিউজ)
news@earthtimes24.com(নিউজ)
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
২০১৭ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত earthtimes24.com