ইউক্রেন সংঘাতেও ‘গেমচেঞ্জার’ হতে পারে তুরস্কের ড্রোন

লেখক:
প্রকাশ: ৩ years ago

রাশিয়ার সঙ্গে যেকোনো সময় যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে আশঙ্কায় ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দিয়ে যেসব দেশ সম্ভাব্য লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করছে, তাদের মধ্যে তুরস্ক অন্যতম। তুরস্কের তৈরি কয়েক ডজন ড্রোন এরই মধ্যেই ইউক্রেনে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া, আঙ্কারা-কিয়েভের মধ্যে চুক্তির ফলে এখন ইউক্রেনেই তৈরি হবে তুর্কি নকশার নতুন ড্রোন।

রাশিয়া-ইউক্রেন সম্ভাব্য সামরিক সংঘাতের পটভূমিতে অনেকের নজর তুরস্ক ও তাদের তৈরি ড্রোনের দিকে। শুধু ইউক্রেন নয়, কার্যত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সংঘাতগুলোতে তুরস্কের তৈরি ড্রোনগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর একমাত্র মুসলিম সদস্য দেশ তুরস্ক। তাদের সেনাবাহিনী ন্যাটো জোটের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম, সংখ্যায় যার স্থান যুক্তরাষ্ট্রের পরেই। তাছাড়া, ন্যাটো মিত্রদের মতো তুরস্কের হাতেও রয়েছে উন্নত সামরিক প্রযুক্তি।

তুরস্কে বসবাসরত প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক আরদা মেভলুতোগলু জানান, তুর্কি সরকার গত ২০ বছরে একটি শক্তিশালী ড্রোন বাহিনী গড়ে তুলেছে। দেশটির প্রতিরক্ষা শিল্পকে উন্নত করার জন্য ড্রোন প্রযুক্তিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে তুরস্ক এ অঞ্চলে এক নজিরবিহীন অবস্থানে রয়েছে, ব্যতিক্রম শুধু ইসরায়েল।

তুর্কি ড্রোন সম্পর্কে কী জানি?
ইউএভি (আনম্যানড এরিয়াল ভেহিকল) বা মনুষ্যবিহীন আকাশযানকেই বলা হয় ড্রোন। তুরস্কে এর প্রধান উৎপাদনকারী দুটি প্রতিষ্ঠান- বায়কার ডিফেন্স ও টার্কিশ এ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ।

আরদা মেভুতোগলুর জানান, তুরস্কের সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলো এ ধরনের ১৫০টির বেশি ড্রোন ব্যবহার করছে। তাদের কাছে অপেক্ষাকৃত ছোট আকৃতির পর্যবেক্ষণ ও কামিকাজে ড্রোনও রয়েছে।

ইউক্রেনের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক
তুরস্ক ২০১৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ইউক্রেনের কাছে অনেকগুলো বায়রাক্টার টিবিটু ড্রোন বিক্রি করেছে। ইউক্রেনও চায় তুরস্কের মতো ন্যাটোর সদস্য হতে। কিন্তু এখন তাদের একদিকে যেমন পূর্বাঞ্চলে রুশ-সমর্থিত বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছে, অন্যদিকে তৈরি হতে হচ্ছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সম্ভাব্য যুদ্ধের জন্যও। রাশিয়া গত কয়েকমাসে ইউক্রেন সীমান্তে এক লাখের বেশি সৈন্য মোতায়েন করেছে এবং তারা যেকোনো সময় ইউক্রেন আক্রমণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করছে পশ্চিমারা। যদিও রাশিয়া বরবরই এমন পরিকল্পনার কথা অস্বীকার করে আসছে।

এর মধ্যেই গত ৩ ফেব্রুয়ারি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিস্যেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান ইউক্রেন সফরে যান এবং ড্রোন বাণিজ্য বাড়াতে উল্লেখযোগ্য একটি চুক্তি করেন। ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছেন, এই চুক্তির ফলে তুরস্কের উৎপাদনকারীদের জন্য ইউক্রেনে ড্রোন কারখানা স্থাপনের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়েছে। ফলে এখন ইউক্রেনেই ড্রোন নির্মাণ করা যাবে।

রাশিয়া কী বলছে?
গত অক্টোবর মাসে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী একটি ভিডিও শেয়ার করে, যাতে দেখা যায়, তুরস্কের তৈরি ড্রোন দিয়ে একটি ডি-৩০ হাউইটজার কামান ধ্বংস করা হচ্ছে, যা সাধারণত ইউক্রেনে রুশ-সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ব্যবহার করে থাকে। রুশ-নির্মিত সামরিক সরঞ্জাম ধ্বংসের পর রাশিয়া এর তীব্র সমালোচনা করে এবং ক্রেমলিন তুরস্ককে হুঁশিয়ারি দেয় যে, তাদের তৈরি ড্রোন ওই অঞ্চলে অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি তৈরি করছে।

আঙ্কারা সম্প্রতি রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু ইউক্রেনের কাছে ড্রোন বিক্রির ফলে বিষয়টি বেশ জটিল হয়ে উঠেছে। রাশিয়ার সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক অনেক দিন ধরেই জটিল, বিশেষ করে সিরিয়ায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকে। সেখানে আঙ্কারা ও মস্কোর পরস্পরবিরোধী স্বার্থ রয়েছে। তবে এর মধ্যেই দেশ দুটি সম্পর্ক উন্নত করারও উদ্যোগ নিয়েছে।

ন্যাটো ও যুক্তরাষ্ট্রের হুমকি সত্ত্বেও তুরস্ক রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিনেছে। এটিকে রাশিয়ার সঙ্গে এরদোয়ানের সম্পর্ক ভালো করার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে।

তুরস্কের ড্রোন কি ইউক্রেন সংঘাতের গতিপথ বদলাতে পারে?
ইউক্রেনে ঠিক কতগুলো তুর্কি ড্রোন রয়েছে তা স্পষ্ট নয়। তবে আরদা মোভুতোগলু বলছেন, ইউক্রেনের জন্য ডনবাস অঞ্চলে রুশ-সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে এসব ড্রোন অত্যন্ত কার্যকর প্রমাণিত হতে পারে।

এই ড্রোনে উন্নত প্রযুক্তির ইলেকট্রো-অপটিক্যাল ক্যমেরা রয়েছে। তার সঙ্গে রয়েছে ডাটা-লিংক সিস্টেম এবং দুই থেকে চারটি বিস্ফোরক, যা প্রিসিশন-গাইডেড অর্থাৎ উড়ে গিয়ে নির্ভুল নিশানায় লক্ষ্যে আঘাত হানতে সক্ষম। তবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ বেঁধে গেলে এসব ড্রোন কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।

মেভলুতোগলু বলেন, রাশিয়ার সামরিক বাহিনী সংখ্যার দিক থেকে যেমন, তেমনি প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও ইউক্রেনের চেয়ে অনেকগুণ এগিয়ে।

তুরস্কের ড্রোন কার কার কাছে রয়েছে?
তুর্কি ড্রোনের ক্রেতার সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। দেশটির রপ্তানিসংক্রান্ত উপাত্তে ড্রোনের সংখ্যা সুনির্দিষ্টভাবে বলা নেই। কিন্তু ধারণা করা হয়, ১৫টির বেশি দেশ তুরস্কের তৈরি বায়রাক্টার ও টিএআই ড্রোন কেনার অর্ডার দিয়েছে।

নিকট অতীতে সিরিয়া ও লিবিয়ার সংঘাতে এবং অতিসম্প্রতি নাগারনো কারাবাখের যুদ্ধে বায়রাক্টার টিবিটু ড্রোনের কার্যকর প্রয়োগ দেখা যায়। এরপর তুর্কি ড্রোনের চাহিদা আরও বেড়ে গেছে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা