ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ছাড়াও অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপের পর বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) আস্থায় নিচ্ছেন অনেকে। ৪০টি রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি সাংবাদিক, নির্বাচনী পর্যবেক্ষক, নারী নেতৃত্ব এবং সর্বশেষ মঙ্গলবার সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও নির্বাচন কমিশনারদের সঙ্গে বৈঠকে করে নিজেদের হালকা মনে করছে বর্তমান কমিশন। এমনকী বিএনপিও ইসির সঙ্গে সংলাপ শেষ করে বলেছে, ‘আমরা কিছুটা আশাবাদী তো বটেই।’
সংলাপে প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রস্তাবগুলোর মধ্যে বিস্তর ফারাক থাকলেও ইসি নিজেদের কিছুটা হলেও আস্থায় আনতে পেরেছে। ইসির কৌশলী নীতিই এর কারণ বলে বিষেজ্ঞরা মনে করছেন। তবে নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা ইসির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বলে তারা মনে করছেন।
জানা যায়, সংলাপে অংশ নিয়ে অধিকাংশ দল নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা চালুর প্রস্তাব জানিয়েছে। কিন্তু এটি ইসির এখতিয়ারভুক্ত নয়। এছাড়া নির্বাচনের সময় সব গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়কে কমিশনের অধীনস্থ করা, নির্বাচনের আগে ও পরে সন্ত্রাস দমনের ব্যবস্থা করা, একই মঞ্চে নির্বাচনের প্রচারণার ব্যবস্থা করা, নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে দ্রুত মামলার নিষ্পত্তি করা, নিবন্ধিত দলগুলোর পরামর্শ নিয়ে একটি জাতীয় ফোরাম করা, সেনাবাহিনী মোতায়েন, ইভিএম ব্যবহার, সীমানা নির্ধারণ, প্রবাসীদের ভোটাধিকার, ‘না’ ভোটের বিধান চালু করা, অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেয়া, সব আইন বাংলায় করা এবং সংরক্ষিত নারী আসন বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন প্রস্তাব পেয়েছে ইসি।
সংলাপে উঠে আশা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করবে ইসি। আগামী বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় নির্বাচন কমিশন ভবনে এ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক’র সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচন কমিশনার কৌশলী হয়ে সংলাপ শেষ করেছে। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা বলে কিছুটা বেকায়দায় পড়েছিল ইসি। কিন্তু সেটাও সামলে উঠেছে। এই আস্থাটা তাদের ধরে রাখতে হবে। এটি ধরে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ।
সংলাপে বিএনপির ২০ প্রস্তাব
১৬ অক্টোবর ইসির সঙ্গে বিএনপির নেতৃবৃন্দ আড়াই ঘণ্টার সংলাপ করে ২০টি প্রস্তাব দেয়। পরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কাছে সাংবাদিকরা জানতে চান সংলাপে বিএনপি সন্তুষ্ট কি না? জবাবে তিনি বলেন, বর্তমান যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, সরকারের যে একটা প্রচণ্ড রকমের অগণতান্ত্রিক আচরণ, সেখানে খুব বেশি আশাবাদী হওয়ার কারণ আছে বলে আমরা মনে করি না। আশার যাত্রাটা শুরু হলো কি না- এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘কিছুটা তো বটেই। আমরা কিছুটা আশাবাদী তো বটেই।’
ওইদিন তফসিল ঘোষণার আগে সংসদ ভেঙে দিয়ে একটি সহায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের প্রস্তাব দেয় বিএনপি। একই সঙ্গে নির্বাচনের সময় বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে সেনা মোতায়েন, ২০০৮ সালের আগের নির্বাচনী আসনের সীমানা পুনর্বহাল, ইভিএম-ডিভিএম পদ্ধতি চালু না করা, ওয়ান ইলেভেন থেকে শুরু করে বর্তমান সরকার কর্তৃক দলের চেয়ারপারসনসহ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত সকল মামলা প্রত্যাহারসহ ২০ দফা সুপারিশ করে দলটি।
আওয়ামী লীগের ১১ প্রস্তাব
বিএনপি সহায়ক সরকারের অধীনে চাইলেও আওয়ামী লীগ বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন চায়। এছাড়া বিএনপি ইভিএমের বিরোধিতা করলেও নির্বাচনে তা ব্যবহারের পক্ষে আওয়ামী লীগ। সীমান পুননির্ধারণের বিপক্ষে দলটি। আর বিএনপি বিচারিক ক্ষমতাসহ সেনা মোতায়েনের পক্ষে থাকলে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী তা সম্ভব বলে জানায় আওয়ামী লীগ। ইসির সঙ্গে সংলাপে দলটি মোট ১১টি প্রস্তাব দেয়।
সরকারি কর্মচারী দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না
সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) বিচারপতি মোহাম্মদ আব্দুর রউফ বলেছেন, ‘আমাদের দেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে বিশৃঙ্খলা। এটা ঠিক করতে না পারলে পারমাণবিক শক্তি দিয়েও নির্বাচন সুষ্ঠু করা যাবে না। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ভোটারকেই দায়িত্ব দিতে হবে। ফাইভ স্টার, থ্রি স্টার নিয়ে ভোটের দিন ঘোরার দরকার নেই। এসপি, ডিসি’র দরকার নেই। ভোটাররাই তাদের এলাকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করবে। এজন্য ৫শ’ জন ভোটারের একটি স্থায়ী ভোটকেন্দ্র গড়ে দিতে হবে। সরকারি কর্মচারী দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না।’
মঙ্গলবার নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বিশেষজ্ঞদের সংলাপ শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন তিনি। বেলা ১১টায় রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও সচিবদের সঙ্গে সংলাপে বসে ইসি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা সংলাপে সভাপতিত্ব করেন। সংলাপে অন্যান্য কমিশনারসহ ইসির ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ উপস্থিত ছিলেন।
কিছুটা আস্থা তৈরি হয়েছে এটি ধারণ করতে হবে
ইসির সঙ্গে মঙ্গলবারের মতবিনিময় সভায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও সিইসি এটিএম শামসুল হুদা বলেন, নির্বাচনে সব পার্টির আসার জন্য ইসির চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, তাদের কাজকর্মে নিরপেক্ষতার প্রমাণ দেয়া। এমন কিছু করা উচিৎ বেন না যেন আস্থা ক্ষুণ্ন হয়। কিছুটা আস্থা তৈরি হয়েছে এটাকে ধারণ করতে হবে।
দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা করে নির্বাচন কমিশনকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, কিছু জিনিস আছে যা ইসির আওতাভুক্ত। কিছু জিনিস আছে ইসির কিছুই করার নেই। জাতীয় নির্বাচনের আগে এ ডায়লগে এর সমাধান হবে না। কেননা, নির্বাচনের আর এক বছর বাকি আছে। নির্বাচন সুষ্ঠু করার দায়িত্ব শুধু ইসির একার নয়। অনেক প্লেয়ার আছে, দলগুলোর অনেক দায়িত্ব আছে। গত নির্বাচন ‘বিএনপি’ বয়কট করায় নির্বাচনের কালচারের ক্ষতি হয়েছে। এজন্য দলগুলোকে সজাগ থাকতে হবে, যেন সবাই নির্বাচনে আসে।
তিনি আরও বলেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা যদি বলেন, এটা আর হবে না। এটা পারবেন না। যে পরিবেশ ও আস্থা আছে এটা মেনে নিয়ে নির্বাচন করতে হবে। ইসি তো এ পরিবর্তন আনতে পারে না। সুতরাং এ নিয়ে আমাদের আলাপই হয়নি। কেননা, এটা পিউরলি রাজনৈতিক দলগুলোর বিষয়। তারা এটা শুধু নির্বাচনের আগে কেন বলবে?
বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে সেনা মোতায়েন সম্পর্কে তিনি বলেন, বর্তমান আইন অনুযায়ী এখন নির্বাহী ও জুডিশিয়াল আলাদা। তাই বিচারিক ক্ষমতা নিয়ে সেনা মোতায়েন সম্ভব নয়। ভোটাররা যেন নির্ভয়ে ভোট দিতে পারেন এবং বাড়ি ফিরতে পারেন সে ব্যবস্থা করতে হবে। সেটা বিজিবি, র্যাব ও পুলিশের মাধ্যমেই করা সম্ভব।
মধ্যস্থাতাকারী হিসেবে দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব কমাতে পারে ইসি
এই সরকারের অধীনেই যদি নির্বাচন হয় তাহলে কমিশন কীভাবে নির্বাচনটাকে বিতর্কমুক্ত করতে পারবে- এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন বলেন, এই ইস্যুটি পিউরলি পলিটিক্যাল ইস্যু। নির্বাচন কমিশন কী করবে? নির্বাচন কমিশনের তো করার কিছু নেই। এটা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের কোনো নির্বাচনেই বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে সেনা মোতায়েন করা হয়নি। বিচারিক ক্ষমতা যে দিতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আর্মি থাকবে। কারণ আমরা আইনের শাসনে বিশ্বাস করি। সেখানে মেজিস্ট্রেট থাকবে, কোর্ট থাকবে।
ইসি মধ্যস্থতাকারী হিসেবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব কমাতে পারে কি না- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যদিও এটা খুব কঠিন কাজ। আমার মনে হয় নির্বাচন কমিশন একটি উদ্যোগ নিতে পারে। এ উদ্যোগ যদি ফেইল করে তাহলে দোষটা তাদের (ইসি) না। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করা ইসির দায়িত্ব। আর এজন্য এ ধরনের উদ্যোগ ইসি নিতে পারে। কিন্তু এ উদ্যোগ যে সফল হবে এমন কোনো গ্যারান্টি নেই। সফল না হলে ইসির কোনো দায় নেই।
তিনি বলেন, আমরা বলেছি উনারা শক্তভাবে, দৃঢ়ভাবে আইনকে প্রয়োগ করবেন। আমি নতুন করে দুটি কথা বলেছি। একটি হলো- নির্বাচনে প্রায় ৬ লাখ লোক কাজ করে। এই লোকগুলো যদি নিরপেক্ষ না থাকে তাহলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। তাদের মোটিভেইট করতে হবে। বহু আগে থেকেই তাদের চিহ্নিত করে ট্রেইন করতে হবে।
ইসিকে তার ক্ষমতা ব্যবহার করতে হবে
‘বিগত নির্বাচন পেট্রল বোমার ওপর দিয়ে করতে হয়েছিল, আগামীতে তা যদি না হয় সে বিষয়ে কী পরামর্শ দিয়েছেন’- এমন প্রশ্ন রাখা হয় সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজের কাছে। তিনি বলেন, আমাদের সময়ে বিরাট একটি দল ও জোট না আসায় আর নির্বাচনে বাধা দেয়ার কারণে আমরা সমস্যায় পড়েছিলাম। যান, মাল সম্পদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু এ নির্বাচন কমিশন ও দেশের জন্য সৌভাগ্য সুন্দর নির্বাচনের জন্য সবাই আগ্রহী হয়ে আছে। এখন ইসির উচিত হবে সুন্দর নির্বাচনের লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া। নির্বাচনী আসন নিয়ে খুব একটা সমস্যা নেই। একইভাবে বিদ্যমান আইনেই নির্বাচন করা সম্ভব।
দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কতটা কঠিন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার মনে হয় ইসি যদি শুধু নির্বাচনের দিকেই লক্ষ্য রাখে তাহলে সরকার থাকায় কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে না। আরপিও এর ৫ ধারা এবং সংবিধানের ১২৬ ধারা অনুসারে ইসিকে যে ক্ষমতাগুলো দেয়া হয়েছে সেগুলো প্রয়াগ করলে যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব। যেখানে প্রয়োজন হবে সেখানে সেনাবাহিনী মোতায়েন করবে। কিন্তু এজন্য সেনাবাহিনীকে মেজিট্রেসি ক্ষমতা দেয়ার দরকার নেই।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে অংশীজনদের সঙ্গে সংলাপ শুরু করেছিল ইসি। এরই ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনারদের পরামর্শ নেয় নির্বাচন কমিশন। এখন পর্যন্ত ৪০টি দলের সঙ্গে বৈঠক করেছে ইসি। এছাড়া সুশীল সমাজ, সাংবাদিক, নির্বাচনী পর্যবেক্ষক ও নারীনেত্রীদের সঙ্গেও সংলাপ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। দীর্ঘ তিন মাস ধরে এ সংলাপ চলে। মঙ্গলবার ছিল সংলাপের শেষ দিন।