আমার ছেলেকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তখন ভয়ে কথা বলতে পারিনি। ছেলে হত্যার পর থেকেই আমি নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে বিচার দিয়েছি। আল্লাহকে বলেছি, আল্লাহ তুমি দেশবাসীকে এই জালিম সরকারের হাত থেকে রক্ষা করো। জালিম সরকারের পতন ঘটাও। আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করেছেন। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পতনে আমি খুশি।
শেখ হাসিনার পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর এভাবেই বুকভরা কষ্ট নিয়ে ছেলে হারানোর শোকে পাথর হয়ে কথাগুলো বলছিলেন কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহত সাগর আহমেদের (২১) বাবা তোফাজ্জল হোসেন।
এসময় তিনি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান।
তিনি বলেন, শেখ হাসিনার নির্দেশেই সাগরসহ শত-শত ছেলে-মেয়েকে এই আন্দোলনে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।
সাগর রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার নারুয়া ইউনিয়নের টাকাপোড়া গ্রামের তোফাজ্জল হোসেনের ছেলে। তিনি মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়তেন। কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে গিয়ে গত ১৯ জুলাই মিরপুর গোলচত্বরে পুলিশের গুলিতে নিহত হন তিনি।
স্বজনরা জানান, গত ১৯ জুলাই বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে সাগর তার বাবাকে ফোন করেন। সবার খোঁজ খবর নিয়ে বিকাশে ১ হাজার টাকা দিতে বলেন। স্থানীয় নারুয়া বাজারে গিয়ে আধাঘণ্টা পর টাকা দেন তোফাজ্জল। পেয়েছেন কিনা নিশ্চিত হতে কল দেন; কিন্তু রিসিভ হয় না। কপালে চিন্তার ভাঁজ। কারণ ঢাকায় যে গণ্ডগোল চলছে, জানেন তোফাজ্জল। দুপুর ১টার পর কল দিতেই থাকেন। মিনিট দশেক পর একবার রিসিভ হলে অপর প্রান্ত থেকে কেউ একজন বলেন, সাগর পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন। তোফাজ্জল নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। আরও কয়েকবার কল দেন, রিসিভ হয় না। শিরদাঁড়া দিয়ে বয়ে চলে ঘামের স্রোত। পরিচিত অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে যতক্ষণে নির্মম সত্য জানলেন, ততক্ষণে সব শেষ!
সাগরের বাবা তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘মাঠে কাজ করা দেখে সাগর প্রায়ই বলত-বাবা, আর ক’টা দিন অপেক্ষা করো। তোমাকে আমি আর রোদে পুড়তে দেব না। আমার সব শেষ হয়ে গেছে। কেউ কখনও এমন করে আর বলবে না। আমার ছেলে কোনও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল না। আমি মাঠে কাজ করে খাই। আমিও কোনও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নাই।
নিহত সাগরের বাবা মো. তোফাজ্জেল হোসেন বলেন, সাগর অত্যন্ত মেধাবী ছিল। সে রাজবাড়ী সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ঢাকায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চেয়েছিল, কিন্তু ভাগ্য সহায় হয়নি। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ মিরপুর বাংলা কলেজে ভর্তি হয়। পরিবারের অভাব অনটনের কারণে আমি তার পড়ার খরচ ঠিকমতো দিতে পারতাম না বলে সে টিউশনি করে নিজের খরচ নিজেই চালাতো। সাগরের স্বপ্ন ছিল বিসিএস ক্যাডার হবে, সরকারি চাকরি করবে। সেই স্বপ্ন নিয়েই চাকরির জন্য কোটা আন্দোলনে গিয়েছিল, ফিরল লাশ হয়ে। আমি শুধু আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলাম যারা সাগরকে হত্যা করেছে তাদের যেন বিচার হয়। আল্লাহ আমার কথা শুনেছে। এই জালিম সরকারের পতন ঘটেছে।