আওয়ামী লীগের আসন্ন ২১তম জাতীয় সম্মেলনে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনেও দলটির মহানগর শাখা ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা নির্বাচনের ধাঁচের ছাপ থাকবে বলে আভাস মিলছে। দলটির নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অপেক্ষাকৃত তরুণ, স্বচ্ছ ভাবমূর্তির ত্যাগী নেতাদেরই স্থান দেওয়া হবে আগামী দিনের কমিটিতে। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময় দলের নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের ওই নেতারা।
দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্বদাতা আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে আগামী ২০ ও ২১ ডিসেম্বর। রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠেয় এ সম্মেলন ঘিরে দলটির নেতাকর্মীদের মাঝে বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনা বিরাজ করছে। সম্মেলনের মাধ্যমে সাধারণত নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন হয়ে থাকে। তবে আওয়ামী লীগের সম্মেলনে দলের সভাপতি পদে যে পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই, সেটা অনেকটাই নিশ্চিত। বাকি সাধারণ সম্পাদক পদসহ নেতৃত্বের অন্যান্য পর্যায়ে পরিবর্তন আসবে বলে ধারণা করা যায়।
আওয়ামী লীগ নেতাদের ভাষ্য অনুযায়ী, বর্তমান সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বড় কোনো অভিযোগ না থাকলেও সাধারণ সম্পাদক পদে অন্য কাউকে দায়িত্ব দেয়ার বিষয়ে একাধিকবার ইঙ্গিত দিয়েছেন দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
দলীয় প্রধানের বরাত দিয়ে সেই সব ইঙ্গিত তুলে ধরে নেতারা জানান, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা মনে করেন, দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে এমন কারও দায়িত্ব পালন করা উচিত- যিনি বঙ্গবন্ধুকে দেখেছেন, স্বাধীনতা সংগ্রাম-মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন, পঁচাত্তরের নৃশংস হত্যাকাণ্ড দেখেছেন। দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থেকে ক্লিন ইমেজ নিয়ে দল ও আদর্শের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন, এমন কাউকেই সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে। পরবর্তী প্রজন্ম থেকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করার সময় এখনো আসেনি বলে মনে করেন সভাপতি শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছ থেকে পাওয়া ইঙ্গিত অনুযায়ী, সাধারণ সম্পাদক পদে পরিবর্তনের আলোচনা হচ্ছে বিভিন্ন পরিসরে। এই পদে দলীয় প্রধানের দেওয়া যোগ্যতার মাপকাঠি অনুযায়ী বর্তমান সাধারণ সম্পাদকসহ ২-৩ জনই রয়েছেন। তাদের মধ্য থেকেই আগামী দিনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হবেন।
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার দেওয়া যোগ্যতার মাপকাঠি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ছাড়া একজন যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও একজন কাযনির্বাহী সদস্য আওয়ামী লীগের নতুন সাধারণ সম্পাদক হতে পারেন। যাদের মধ্যে একজন ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই পদে দায়িত্ব পালন করে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে উঠে এসেছেন। অপর একজন তৃণমূল পর্যায় থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে আসছেন।
আওয়ামী লীগের একাধিক দায়িত্বশীল নেতা জানিয়েছেন, বিগত ২০তম সম্মেলনে ১৭ সদস্যের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যের মধ্যে ৭ জন এসেছিলেন বিদায়ী কমিটি থেকে। ওই কমিটিতে নতুন মুখ এসেছিল অন্তত ৬ জন। বাদ পড়েছিলেন দুই জন। এবার সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য থেকে অন্তত ৭-৮ জনের স্থান হতে পারে উপদেষ্টা পরিষদে। বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত বয়োজ্যেষ্ঠ ও যারা শারীরিকভাবে দলের কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হিমশিম খাচ্ছেন, তাদের সম্মানার্থে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হতে পারে। দলের ৩৪ সদস্যের সম্পাদকমণ্ডলী থেকে পদোন্নতি পেয়ে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হতে পারেন অন্তত আধডজন নেতা, যাদের দীর্ঘদিন যাবত সাংগঠনিক রাজনীতির অভিজ্ঞতা রয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের সভাপতিণ্ডলীর এক সদস্য বলেন, ‘সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হিসেবে আমরা যারা দায়িত্ব পালন করছি তাদের মধ্যে অনেকেই এবার উপদেষ্টা পরিষদে চলে যেতে পারেন। সেখানে সম্পাদকমণ্ডলী থেকে পদোন্নতি পেয়ে আসতে পারেন পরিশ্রমী, মেধাবী ও দক্ষ নেতারা। আমাদের মহানগর শাখার নেতা নির্বাচন ও ধারাবাহিকভাবে চলা সহযোগী সংগঠনগুলোর সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি গঠন প্রক্রিয়ার ছাপ থাকতে পারে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনেও। তবে সবাই নিজ নিজ পদ ধরে রাখতে নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন দায়িত্বশীল নেতা মনে করছেন, ৩৪ সদস্যের সম্পাদকমণ্ডলী থেকে পদোন্নতি পেতে পারেন প্রায় ডজনখানেক নেতা। বিষয়ভিত্তিক ১৭টি সম্পাদকীয় পদ ও সাংগঠনিক সম্পাদক থেকে এসব পদোন্নতি হতে পারে। সম্পাদকমণ্ডলী থেকে পদাবনতি ঘটতে পারে আধডজন থেকে একডজন নেতার। তারা কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য হিসেবে কমিটিতে স্থান পেতে পারেন। এদের মাঝে আবার কারও কারও কেন্দ্রীয় কমিটিতেই স্থান না পাওয়ার শঙ্কাও রয়েছে।
দায়িত্বশীল নেতারা আরও মনে করছেন, কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য হিসেবে যে ২৮ জন দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের মধ্য থেকে পদোন্নতি পেতে পারেন ৬ থেকে ৮ জন। আর নির্বাহী সদস্য থেকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান না পাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন ২ থেকে ৪ জন নেতা। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য থেকে উপদেষ্টা পরিষদে যেতে পারেন এমন নেতা রয়েছেন ২ থেকে ৪ জন।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘আমরা আশা করি ভালো কিছু হবে। আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহ্যবাহী দলকে চালাতে পারেন, সার্ভিস দিতে পারেন- এমন যোগ্যতা আছে; সততা, নিষ্ঠা এবং দল চলানোর মতো নেতৃত্বগুণ আছে, এমন কেউই দায়িত্ব পাবেন।’
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান বলেন, ‘আমাদের সহযোগী সংগঠন থেকেও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে পদায়ন করা হতে পারে।’
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘একটা পদে কোনো পরিবর্তন আসবে না। সেটা হচ্ছে আমাদের পার্টির সভাপতি। আমাদের সভাপতি দেশরত্ন শেখ হাসিনা। তিনি ছাড়া আমরা কেউই অপরিহার্য নই। তিনি এখনও আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক অপরিহার্য। তৃণমূল পর্যন্ত সবাই তার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ। এর পরের পদটা কাউন্সিলরদের মাইন্ড সেট করে দেয়। সেটাও তিনি (সভাপতি শেখ হাসিনা) ভালো করে জানেন।’
‘আর দল কীভাবে চলবে, কাকে দিয়ে চলবে- সেটাও তিনি জানেন। তিনি যেটা ভালো মনে করবেন সেটাই করবেন। পরিবর্তন করলেও তার ইচ্ছা, তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন। এ ব্যাপারে কারও কোনো কথা থাকবে না। পরিবর্তন হলেও আমরা স্বাগত জানাব, আর তিনি যদি (বর্তমান সাধারণ সম্পাদককে বহাল) রাখেন, সেটাও তার ইচ্ছা। পার্সোনালি আই অ্যাম নট ইন্টারেস্টেড (ব্যক্তিগতভাবে আমি আগ্রহী নই)।’