ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য বিদায়ী উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক’র ‘সিটিং অ্যালাউন্স’ বাবদ সোয়া কোটি টাকা না নেয়ার তথ্য নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। হিসাবে দেখা দিয়েছে গরমিল। একজন উপাচার্য কীভাবে মূল বেতনের বাইরে সিটিং অ্যালাউন্স বাবদ এত বড় অংকের অর্থ পেতে পারেন- তা নিয়েও তৈরি হয়েছে বিতর্ক।
এমন বিতর্কের মুখে গত মাসে (আগস্ট) বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে জানতে চাইলে তারা তৎকালীন উপাচার্যের সোয়া কোটি টাকা সিটিং অ্যালাউন্স না নেয়ার সপক্ষে কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি। ইতোপূর্বে এমন তথ্যের বিষয়ে চ্যালেঞ্জ করা হলেও এখন এ বিষয়ে বক্তব্য দেয়ার আগে উপাচার্যের ‘মহত্ব’কে বড় মনে করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দীন। বাংলাদেশের কোনো উপাচার্য সিটিং অ্যালাউন্স নেননি- এমন প্রমাণ থাকলে উপস্থাপন করতে বলেন তিনি।
ঢাবির কোষাধ্যক্ষ কামাল উদ্দিনের ফেসবুকে দেয়া স্ট্যাটাস (২৫ জুন)
গত আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক দুই উপাচার্য, দুই উপ-উপাচার্য (যাদের একজন বর্তমানে উপাচার্য হিসেবে সাময়িক সময়ের জন্য নিয়োগ পেয়েছেন), তিনজন সিন্ডিকেট সদস্য এবং অতীতে সিনেট-সিন্ডিকেটসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন এমন সাত শিক্ষকের সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজ’র এ প্রতিবেদকের।
তাদের মধ্যে কয়েকজন বলেন, সাত বছরে একজন উপাচার্যের সিটিং অ্যালাউন্স বাবদ সোয়া কোটি টাকার অংকের হিসাব সম্পূর্ণ ‘বায়বীয়’। বাস্তবতার নিরিখে যা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাদের দাবি, বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী একজন উপাচার্য সাত বছরে সিটিং অ্যালাউন্স বাবদ সর্বোচ্চ ২০-২৫ লাখ টাকা পেতে পারেন।
গত সাত বছরে যদি সিটিং অ্যালাউন্স বাবদ সোয়া কোটি টাকা আরেফিন সিদ্দিকের প্রাপ্য হয়, তাহলে এর মানে দাঁড়ায় প্রতি মাসে সিটিং অ্যালাউন্স বাবদ তিনি পেয়েছেন এক লাখ ৪৮ হাজার ৮১০ টাকা, যা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বোর্ডে সর্বোচ্চ অংশগ্রহণ থাকে উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. নাসরীন আহমাদের। তিনি ২০১২ সালের জুন থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত সর্বোচ্চ অংশ নিয়েছেন সিলেকশন বোর্ডের সভায়। এখান থেকে সিটিং অ্যালাউন্স বাবদ সর্বমোট আট লাখ ৬০ হাজার টাকা সম্মানি পেয়েছেন তিনি। আর অন্যগুলোর সিটিং অ্যালাউন্স বাড়িয়ে ধরলে চার লাখ ৫০ হাজার টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। সর্বমোট তার সম্মানি ১৩ লাখ ১০ হাজার টাকা, এমন তথ্যই দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের একটি সূত্র।
গত ১৭ জুন বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটের বার্ষিক অধিবেশনে লিখিত বাজেট বক্তৃতায় কোষাধ্যক্ষ বলেন, একটি বিষয় উল্লেখ না করে পারছি না যে, এখনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক নরেশ সেনগুপ্তের মতো ত্যাগী অধ্যাপক শিক্ষক আছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চপদে অধিষ্ঠিত উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষসহ সবাই বিভিন্ন পর্যায়ের সভার জন্য ‘সিটিং অ্যালাউন্স’ অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করেন। শুধু আমাদের উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘাটতি কমানোর জন্য কোনো সিটিং অ্যালাউন্স গ্রহণ করেননি। আমার হিসাবে গত সাত বছরে তিনি প্রায় ১.২৫ (এক কোটি ২৫ লাখ টাকা মাত্র) কোটি টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাশ্রয় করেছেন। উচ্চ নৈতিকতার এ এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত নয় কি?’
সিনেট অধিবেশনে দেয়া কামাল উদ্দিনের লিখিত বক্তব্য
বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষের এমন বক্তব্যের পর বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। আরেফিন সিদ্দিকপন্থী শিক্ষকরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্নভাবে উপাচার্যের ‘মহত্ব’ নিয়ে লেখালেখি করেন। কিন্তু তার বিরোধী অংশ শুরু থেকেই এ বক্তব্যকে ‘বায়বীয়’ বলে আসছিল।
অন্যদিকে কোষাধ্যক্ষ তার বক্তৃতায় ‘অন্যরা অত্যন্ত আনন্দের সাথে গ্রহণ করেছেন’ বলে যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে যারা সিটিং অ্যালাউন্স গ্রহণ করেছেন তাদের হেয় করা হয়েছে বলে অভিযোগ অনেকের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শিক্ষক বলেন, ‘এতে আনন্দিত কিংবা বিরাগ হওয়ার কি আছে?’ এরই পরিপ্রেক্ষিতে টাকার হিসাব নিয়ে কোষাধ্যক্ষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাসের মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। ইংরেজি ভাষায় দেয়া ওই স্ট্যাটাসে তিনি লেখেন, ‘যদি কেউ উপাচার্যের সোয়া কোটি টাকা ফেরত দেয়ার তথ্যকে ভুল প্রমাণ করতে পারেন, তাহলে আমি কোষাধ্যক্ষ হিসেবে বাকি সময়ে বিনা বেতনে কাজ করতে প্রস্তুত।’
সিটিং অ্যালাউন্সের শুরুর ঘটনা অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০০৩ সালে অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালনকালে সিটিং অ্যালাউন্সের আইনটি চালু করেন। এই আইনুযায়ী বিভিন্ন সভায় উপস্থিত থেকে শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সম্মানি হিসেবে ৫০০ টাকা পাওয়ার কথা। তবে এটি উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যর জন্য প্রযোজ্য নয় বলেও ওই আইনে উল্লেখ করা হয়।
এ বিষয়ে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ বলেন, সিটিং অ্যালাউন্স শিক্ষকদের জন্য ছিল। কিন্তু উপাচার্য, উপ-উপাচার্যের জন্য ছিল না। সোয়া কোটি টাকা তো অন্য হিসাব, তার (আরেফিন সিদ্দিক) সিটিং অ্যালাউন্স বাবদ টাকা নেয়ার কথা নয়। ওই আইনেই এটি স্পষ্টভাবেই বলে দেয়া হয়েছে। কারণ ওইসব প্রোগ্রামে অংশ নেয়া উপাচার্য, উপ-উপাচার্যের দায়িত্ব। তারা এসব মিটিং করবেন। কিন্তু সিটিং অ্যালাউন্স পাবেন না।
এ বিষয়ে জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি বিষয়টি ‘কন্ট্রোভার্সিয়াল (বিতর্কিত)’ উল্লেখ করে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর সিন্ডিকেটের অনুমোদিত সিটিং অ্যালাউন্স
জানা গেছে, বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা সিটিং অ্যালাউন্স হিসেবে বেশ কয়েকটি খাত থেকে সম্মানি পেয়ে থাকেন। যার মধ্যে রয়েছে- সিন্ডিকেট সভা, ডিন্স কমিটির সভা, সিলেকশন বোর্ড সভা, তদন্ত কমিটির সভা, ফিন্যান্স কমিটির সভা ও উন্নয়ন প্রকল্পের সভা। এর মধ্যে একমাত্র সিলেকশন কমিটিরই সভা মাসে পাঁচ-ছয়টি হয়। এটি সর্বোচ্চ। অন্যগুলোর মাসে একটি বা বিশেষ কারণে দুটি হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বরের সিন্ডিকেটের এক সিদ্ধান্তে বিভিন্ন সভার সম্মানি বর্ধিত করা হয়। এটি তৎকালীন উপাচার্য আরেফিন সিদ্দিকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সিন্ডিকেটের প্রতিটি সদস্য এবং সভাপতি প্রতিটি সভার জন্য সম্মানি বাবদ পাঁচ হাজার টাকা; ডিন্স কমিটির সভায় উপস্থিত সদস্যরা দুই হাজার এবং সভাপতি তিন হাজার টাকা; সিলেকশন কমিটির প্রতি সভায় সদস্য দুই হাজার এবং সভাপতি তিন হাজার টাকা; তদন্ত কমিটির প্রতি সভায় সদস্য দুই হাজার এবং সভাপতি তিন হাজার টাকা; ফিন্যান্স কমিটির সভায় উপস্থিতির জন্য সব সদস্য এবং সভাপতি তিন হাজার টাকা সম্মানি পাবেন। ২০১৪ সাল পর্যন্ত এই সম্মানী ছিল বর্তমানের অর্ধেক, কোনটি তার থেকেও একটু বেশি।
উল্লেখিত কমিটিগুলোর মধ্যে তদন্ত কমিটি ও ফিন্যান্স কমিটির সভায় উপাচার্য থাকেন না। এর বাইরে প্রভাষক ও সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগ বোর্ডের সভায়ও তিনি থাকেন না। তবে আরও কয়েকটি খাত থেকে উপাচার্য সিটিং অ্যালাউন্স পান। সংশ্লিষ্টরা বলেন, ‘এই টাকার অংক কোনোভাবেই মাসে এক লাখ ৪৮ হাজার ৮১০ টাকা হতে পারে না।’ বেশির ভাগ সভারই সভাপতিত্ব করেন উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) ও উপ-উপাচার্য (প্রশাসন)। তাই তাদের দু’জন থেকে সিটিং অ্যালাউন্স হিসেবে সম্মানি কমই পাওয়ার কথা আরেফিন সিদ্দিকের, এমনটি বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন সূত্রে জানা গেছে, গত ২০১২ সালে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত পাঁচ বছরে উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. নাসরীন আহমাদ সিটিং অ্যালাউন্স হিসাবে পেয়েছেন প্রায় ১৩ লাখ ১০ হাজার টাকা। অন্যদিকে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে গত এক বছরে আরেক উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান সিটিং অ্যালাউন্স হিসাবে পেয়েছেন সর্বমোট দুই লাখ ২০ হাজার টাকা।
এ বিষয়ে উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. নাসরীন আহমাদ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কমিটির সভা থেকে সিটিং অ্যালাউন্স বাবদ সম্মানি পেয়ে থাকি। যার মধ্যে রয়েছে- সিন্ডিকেট, তদন্ত, ডিন্স, সিলেকশন বোর্ডের সভাসহ অন্যান্য। সবগুলো নিয়ে যদি আমি বাড়িয়েও বলি তা হলে বছরে আমার সম্মানি দুই লাখ টাকার কম-বেশি হবে।
উপাচার্যর সিটিং অ্যালাউন্সের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি অনেক বেশি মনে হচ্ছে, মিলানো যাচ্ছে না।’
অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘উপ-উপাচার্য হিসেবে যোগদানের পর গত এক বছরে আমি দুই লাখ ২০ হাজার টাকার কিছু কম-বেশি সম্মানি পেয়েছি। টাকার পরিমাণ অন্যদের থেকে কিছু বেশি কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘হতে পারে আমি ফিন্যান্স কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে কিছু সিটিং অ্যা্লাউন্স বেশি পেয়েছি। তবে সামগ্রিকভাবে প্রাপ্তির যোগ নির্ভর করে তদন্ত কমিটি/সিলেকশন বোর্ডের সংখ্যার ওপর। কিন্তু উপাচার্যের সিটিং অ্যালাউন্স সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি আমারটি বলেছি। উপাচার্য স্যারের বিষয়ে আমার বলার কিছু নেই।’
এদিকে উপাচার্যের সোয়া কোটি টাকার সিটিং অ্যালাউন্স না নেয়ার হিসাব চাওয়া হলে কিছুটা বিরক্ত হন কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক কামাল উদ্দীন। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘এটা তো সিনেটে আমার বক্তৃতার মধ্যে আছে। ওখান থেকে নিয়ে নেন। আগে বাংলাদেশের কোনো উপাচার্য সিটিং অ্যালাউন্স নেননি- এমন প্রমাণ থাকলে কথা বলেন। আর এটা ভালো না লাগলে যেটা বলছি, এটা ঠিক আছে। বাংলাদেশের অন্যান্য উপাচার্যের জিজ্ঞাসা করেন, আপনি কত টাকা নিয়েছেন।’
অনেকে টাকার অংক নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সেটা পরে, আগে বলেন কোন উপাচার্য টাকা নেননি; এ রকম একটা ধরে নিয়ে আসেন। এর পরে কথা বলেন।’