আরেক হাতিরঝিল বানাতে উচ্ছেদ হবে কড়াইল বস্তির ৩৬০২ পরিবার

লেখক:
প্রকাশ: ৪ years ago

রাজধানীর মগবাজার থেকে গুদারাঘাট (গুলশান-১ ও বাড্ডার লিংক রোডের মাঝখান) পর্যন্ত বিস্তৃত লেক নিয়ে বর্তমান হাতিরঝিল। এখানে জমির পরিমাণ ৩০০ একর। লেকের একটা অংশ গুদারাঘাট থেকে পূর্ব দিকে বয়ে গেছে। গুদারাঘাট থেকে পূর্ব দিকের বনানী গোরস্থান পর্যন্ত আরও ২৯৮ একর লেক নিয়ে নির্মাণ করা হবে আরেকটি হাতিরঝিল। ফলে এটি প্রায় ৬০০ একরের নিরবচ্ছিন্ন লেক বা হাতিরঝিলে রূপ নেবে। এটি বাস্তবায়নের পর মগবাজার থেকে বনানী গোরস্থান পর্যন্ত পানিপথে ওয়াটার ট্যাক্সি দিয়ে বা ফুটপাত দিয়ে হেঁটেও একটানা যাওয়া যাবে।

গুদারাঘাট থেকে বনানী গোরস্থান পর্যন্ত লেকের সৌন্দর্য বৃদ্ধি, সড়ক-ব্রিজ-ফুটপাত নির্মাণসহ এই কাজ বাস্তবায়নে ‘গুলশান-বনানী-বারিধারা লেক উন্নয়ন প্রকল্পে’র কাজ ২০১০ সালের জুলাইয়ে শুরু হয়েছিল। শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৩ সালের জুনে। এরপর ১০ বছর চলে গেছে, কিন্তু প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি। মাঝখানে চারবার প্রকল্পের সময় বাড়ানো হয়েছে। এবার পঞ্চমবারের মতো সময় বাড়ানোর প্রস্তাব এসেছে। পাশাপাশি এসেছে এক হাজার ৯১ শতাংশ খরচ বাড়ানোর প্রস্তাব। এতদিন প্রকল্পটির মোট খরচ ছিল ৪১০ কোটি ২৫ লাখ ৫২ হাজার টাকা। এখন চার হাজার ৪৭৫ কোটি ৮৫ লাখ ৮০ হাজার টাকা বাড়িয়ে চার হাজার ৮৮৬ কোটি ১১ লাখ ৩২ হাজার টাকা খরচের প্রস্তাব এসেছে।

গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। তারা প্রকল্পটির এসব প্রস্তাবসহ সংশোধনীর জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।

প্রকল্প সূত্র জানায়, এবারের প্রস্তাবে লেক দখল করে গড়ে ওঠা কড়াইল বস্তির ৪৩ একর জমি অধিগ্রহণ করবে রাজউক। ৪৩ একর জমিতে থাকা ৩৬০২টি পরিবারকে উচ্ছেদ করবে তারা। ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রত্যেক পরিবারকে ৪৭ হাজার টাকা করে দেয়া হবে।

আরডিপিপিতে (সংশোধিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) উল্লেখ আছে, ‘এ প্রকল্পের আওতায় অধিগ্রহণ করা হবে ৮২ দশমিক ৫৬ একর জমি। ভূমি অধিগ্রহণ ও স্থাপনার ক্ষতিপূরণ বাবদ ব্যয় হবে ২০৩ কোটি ৬৭ লাখ টাকা।’

 

এ বিষয়ে রাজউক কর্মকর্তা এবং গুলশান, বনানী ও বারিধারা লেক উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক আমিনুর রহমান সুমন  বলেন, ‘এই লেকটা বড়লোকরা যেমন দখল করেছে, গরিবরাও করেছে। আমাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে লেকটা উদ্ধার করা। লেকটা কিন্তু পানির চ্যানেল। মোট লেকটা হচ্ছে ২৯৮ একর। তার মধ্যে ৮২ একর জায়গা উদ্ধার করব। কড়াইল বস্তির লেকটা যেখানে আছে, সেখান থেকে উদ্ধার করব ৪৩ একর। কড়াইল বস্তি না কিন্তু, বস্তি পাশের অংশ। বস্তি ইনটেক থাকবে। শুধু ওয়াটার বডির (পানি চ্যানেলের ওপর গড়ে উঠা বস্তি) ওপর যে ঘরগুলো আছে, সেগুলো উচ্ছেদ করব। এটা আগে থেকেই একটা লেক। লেকের ওপর ওরা ঘর করে থাকছিল।’

‘কড়াইল বাস্তিতে প্রায় ৭০ হাজার পরিবার। ওখানে আমি হাত দিচ্ছি না। ওই জায়গায় আমার যাওয়ার ক্ষমতাই নেই। আমরা শুধু ওয়াটার বডির ওপর যে জায়গাটা, সেটা নিয়ে কাজ করব। আমরা ৩৬০২টি পরিবারকে পুনর্বাসন করব’— যোগ করেন এ প্রকল্প কর্মকর্তা।

৮২ একরের ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘কড়াইল মৌজায় ৪৩ একর টিঅ্যান্ডটির জায়গা। কিছু জায়গা আছে মহাখালী মৌজায়, সেখানে পাবলিক ল্যান্ড (ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি) ২৫ একর। শুটিং কমপ্লেক্সের পেছন থেকে লেক বরাবর একটা রাস্তা ভারতীয় দূতাবাস পর্যন্ত চলে গেছে। ওই রাস্তায় আছে ১০ একর। আর বাড্ডা মৌজায় আছে ৩ একর।’

সম্প্রতি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে প্রকল্পের এ প্রস্তাবের ওপর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে পরিকল্পনা কমিশন প্রশ্ন তুলে বলেছে, ‘২০১৮ সালের ১১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত একনেক সভায় কড়াইল বস্তি থেকে কত পরিবারকে উচ্ছেদ করা হবে, তাদের কোথায় এবং কীভাবে পুনর্বাসন করা হবে, তার পূর্ণাঙ্গ স্টাডি এবং যথাযথ পরিকল্পনাসহ ডিপিপি পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। প্রস্তাবিত আরডিপিপিতে সংযোজিত এ সংক্রান্ত সার্ভে প্রতিবেদনে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট সুপারিশ নেই। আরডিপিপি পৃষ্ঠা- ৪০৫ নম্বরে শুধু তিন হাজার ৬০২টি পরিবারকে পুনর্বাসনের জন্য ১৭ কোটি টাকার সংস্থানের প্রস্তাব রয়েছে, যা থেকে উচ্ছেদপরবর্তী পুনর্বাসনের জন্য পরিবারপ্রতি ৪৭ হাজার টাকা করে দেয়া হবে মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে। কড়াইল বস্তিবাসীদের পুনর্বাসন পরিকল্পনা সম্পর্কে বাস্তবায়নকারী সংস্থা সভাকে অবহিত করতে পারে।’

প্রত্যেক পরিবারকে ৪৭ হাজার টাকা ছাড়া পুনর্বাসনের আর কোনো সুযোগ-সুবিধা দেয়ার পরিকল্পনা নেই বলে জানান আমিনুর রহমান সুমন। তিনি বলেন, ‘খরচ বাড়ানো সম্ভব নয়।’

প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘সরকার ভূমির মূল্য দিয়ে পুনর্বাসন করে থাকে। রুলস অনুযায়ী, ভূমি অধিগ্রহণ করলে টাকা দিতে পারব। এখানে সমস্যা হচ্ছে, কড়াইল বস্তিতে যারা থাকেন তারা ঘরেরও মালিক নয়, ভূমিরও মালিক নায়। ভূমির মালিক হচ্ছে সরকারের টিঅ্যান্ডটি। তার মানে, ভূমির মূল্যটা কড়াইলবাসীদের দিতে পারছি না। আর ঘরটাও তার নয়। তারা ভাড়া থাকে। সেটাও তারা পাচ্ছে না। লিগ্যালি আমরা তাদের জমি বা ঘরের মূল্য দিতে পারি না। কিন্তু তারা তো থাকে। একটা জায়গায় তারা যে শিফটিং হবে, সেই খরচটা তো তাদের লাগবে। শিফটিং এবং দু-তিন মাস যেন তারা খেয়ে-পরে থাকতে পারে, সেজন্য প্রত্যেক পরিবারকে ৪৭ হাজার টাকা দেব। এ বিষয়ে এনজিওর মাধ্যমে আমরা প্রত্যেকটা কক্ষে গিয়ে জরিপ করেছি, তাদের সঙ্গে আলাপ করেছি। তোমরা কী চাও? তোমরা এ ধরনের একটা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কেন থাকো? তাদের সঙ্গে আলাপ করে তারা যেভাবে চেয়েছে, সেভাবেই আমরা প্রস্তাব করেছি।’

যারা লেকের ওপর ঘর বানিয়েছে, তাদের কী হবে— জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘তাদের শাস্তি হওয়া উচিত।’ তাদের আইনের আওতায় আনবেন কি-না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘জায়গাটা তো এখন আমাদের হাতে নেই। এর মালিক এখন টিঅ্যান্ডটি। আর অন্যের মালিকানার জায়গায় তো আমরা ইচ্ছা করলেও যেতে পারব না। যখন আমাদের কাছে ভূমি অধিগ্রহণ হয়ে আসবে, তখন আমরা সেনাবাহিনীসহ কাজ করব। তখন আমরা ওই বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাব।’

প্রকল্পের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে আমিনুর রহমান সুমন বলেন, ‘আমাদের মূল উদ্দেশ্য লেকটাকে পুনরুদ্ধার করা এবং এটিকে একটা স্থায়ী রূপ দেয়া। লেকের দুই পাশে ওয়াকওয়ে ও রাস্তা করা। যখন রাস্তা হয়ে যাবে তখন রাস্তা চলবে। তখন দুদিন পরপর এটা আমার জায়গা, এটা ওমুকের জায়গা—এসব কথা কেউ বলতে পারবে না। আরেকটা বিষয় হলো, গুদারাঘাট পর্যন্ত নৌকা দিয়ে আসা যায়। এরপর কিন্তু আর যাওয়া যায় না। প্রকল্পটির মাধ্যমে এই অঞ্চলে নতুন একটা ট্রান্সপোর্ট রুট তৈরি করব। মগবাজার থেকে বনানীর গোরস্থান পর্যন্ত নৌকা দিয়ে চলে যাওয়া যাবে। কেউ যদি মনে করেন, হেঁটে যাবেন, তাহলেও পারবেন।’

 

দীর্ঘদিনের প্রকল্প, এখনও বিশেষ অগ্রগতি নেই কেন— জবাবে তিনি বলেন, ‘টাকা বরাদ্দ নেই। আর শাহজাদপুরে আমরা কিছু রাস্তা করেও ফেলেছি। ওখানে অনেকের ভূমি অধিগ্রহণের টাকা এখনও দিতে পারিনি। সাবেক মেয়র আনিসুল হক প্রচণ্ড সহযোগিতা করেছিলেন। তার কারণে ওখানকার লোকজন মামলা পর্যন্ত তুলে নিয়েছিলেন।’

৪৩ একর বস্তি উচ্ছেদে যেসব বিপদ

এই তিন হাজার ৬০২টি পরিবারের স্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থা ছাড়া উচ্ছেদ করা উচিত নয় বলে মনে করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান।

শঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘এটা বিশ্লেষণ করে দেখা উচিত যে, এই উচ্ছেদের প্রয়োজন আছে কি-না। যদি অন্য কাউকে প্লটগুলো দেয়ার পাঁয়তারা হয়, সেটা খারাপ কিছু নিয়ে আসবে। ৪৩ একর বড় এলাকা। কড়াইল বস্তি নিয়ে রাজউক, টিঅ্যান্ডটি, আইসিটি মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নানা ধরনের পরিকল্পনা আমরা দেখি। এর মূল কারণ খাস জমি। এগুলোসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের এ এলাকা নিয়ে মাস্টার প্ল্যান আছে। সেসব মাস্টার প্ল্যান যেন বাস্তবায়িত না হয়। অন্য কারও মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়ন হলে কিন্তু এটার ন্যায্যতা পাবে না।’

‘এই শহরে নিম্নবিত্তের আবাসনের জন্য কতটুকু ভূমি তারা সরবরাহ করতে পারছে? পূর্বাচলে যে নতুন শহর করেছে, সেখানে মাত্র ২ ভাগ ভূমি আছে নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য। আমাদের ঢাকার জনসংখ্যা অনুযায়ী, ১০ ভাগের মতো ভূমি নিম্ন আয়ের মানুষের আবাসনের জন্য নির্ধারণ করা উচিত’ বলেও মনে করেন আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি আরও বলেন, ‘এই যে তিন হাজার ৬০২টি পরিবার, তারা কোথায় আশ্রয় নেবে? তারা যদি যায়, তাহলে তো আরেকটা বস্তিতে যাবে। এই টাকা দিয়ে আরেকটা বস্তিতে যাওয়া ছাড়া তো উপায় নেই। এ ধরনের পর্যাপ্ত বস্তি আছে কি-না? এই বিষয়গুলো কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে উচ্ছেদ না করে কাজটা করা যায় কি-না?’

তিনি বলেন, ‘তারা যেভাবে থাকে, সেটা মানবেতর। অবৈধভাবে যারা থাকেন বা অল্প টাকা ভাড়া দিয়ে যারা থাকেন, তাদের জন্য নগরে ভূমি বাড়ানো দরকার। তাদের জন্য যদি সরকারের তরফ থেকে ভূমি দেয়া যায়, যেখানে তারা ভাড়া দিয়ে থাকবেন, ভূমিটা যদি সরকার বেসরকারি খাতকে সংযুক্ত করে বাড়িঘর বানিয়ে ভাড়া দিতে পারে, সেই আলোচনাও রাজউকের করা প্রয়োজন।’

কড়াইলে যে টাকা ভাড়া দিয়ে তারা থাকে, সেই টাকা দিয়ে অন্য কোথাও উঠবে— এর উত্তরও পাওয়া যাচ্ছে না উল্লেখ করে আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘শুধু সেই তিন হাজার ৬০২টি পরিবার নয়, তারা যে পরিমাণ টাকা দিয়ে থাকেন বস্তিতে, এই ক্যাটাগরির অন্য যারা আছেন, তারাও মানসম্মত বাসায় যেন এই টাকা দিয়েই থাকতে পারেন, সরকারের তরফ থেকে এমন উদ্যোগও দরকার।’

তাদের বিকল্প বাসস্থান কোথায় হতে পারে, সম্ভাব্য জায়গাগুলো চিহ্নিত করার জন্য সহযোগিতা করাও রাজউকের দায়িত্ব। শুধু টাকা দেয়াটাই দায়িত্ব নয়। সেই সহযোগিতা কীভাবে করবে, তা দেখাও রাজউকের দায়িত্ব বলে মনে করেন তিনি। তার মতে, ‘শুধু তো এই তিন হাজার ৬০২টি পরিবারই অবৈধ থাকে না, তারা কিন্তু ভাড়া দিয়ে থাকে। পুরো বিষয়টা নিয়ে এই কড়াইল বস্তিতে যারা অবৈধভাবে আয় করছেন, এটা নিয়েও আলোচনা হওয়া উচিত। এখানে সরকারের হাত দেয়া উচিত।’

‘দেশে কিছু নাই বিদায় এনও আইসা থাকতাছি’

সরেজমিন কড়াইল বস্তিতে গিয়ে দেখা যায়, লেকের ওপর বাঁশ-খুঁটি দিয়ে অল্পকিছু ঘর ওঠানো। ভরাট করে বাকি ঘরগুলো তৈরি করা হয়েছে। সেসব ঘরে পৌঁছার জন্য কিছু জায়গায় পাকা রাস্তার ব্যবস্থাও রয়েছে।

লেকপাড়ের একটি দোকানের সামনে বসে গল্প করছিলেন ফোরন মিয়া। তিনি এই বস্তিতে ২২ বছর ধরে আছেন। প্রশ্ন করে তিনি বলেন, ‘আমরা এনের নাগরিক, এনের ভোটার। এ দেশে রোহিঙ্গারা থাকতে পারলে আমরার উচ্ছেদ করার কারণ কী?’

 

‘দেশে নাই বিধায় এনও আইসা থাকতাছি। ময়লা জাগার মধ্যে থাকতাছি। আমরার তো দেশে কিছু নাই, অসহায়’— যোগ করেন ফোরন মিয়া।

প্রতিটি পরিবারকে ৪৭ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিয়ে বিদায় জানানোর বিষয়ে লেকপাড়ের এই বাসিন্দা বলেন, ’ঢাকার অন্য জায়গায় কই থাকব? অন্য জায়গায় ভাড়া দিয়া থাকার মতো অইলে আমি বস্তিত থাকতাম? নাই বিদায় বস্তিতে আইসা পইড়া রইছি। আমার কী সখ নাই, আমার পোলাপান একটু ভালো পরিবেশে থাকুক, আমার বাপ-মা, আমি ভালো পরিবেশে থাকি?’

৪৭ হাজার টাকা যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন ফোরন মিয়া। বলেন, ‘২৫০০ টাকা ভাড়া দিয়ে বস্তিতে থাকি। বিদ্যুৎ, পানিসহ তিন হাজার টাকা খরচ পড়ে। এখান থেকে সরে গেলে কমপক্ষে ঘরভাড়া হবে পাঁচ হাজার টাকা। তাছাড়া এনে যে পরিবেশ, ওই জায়গায় তো এই পরিবেশ নয়। একটু ভালো পরিবেশে থাকতে অইব। ভালো পরিবেশে চলতে অইব। এনে আমি ২০ টাকার মাছ আইন্যা খাইতে পারি, ওইসব জায়গায় তো এই পরিবেশ নাই। কমপক্ষে এক-দেড় কেজি মাছ কিনে খাইতে অইব, ৫-৬শ’ টাকা লাগব। এই হানে যে টাকা দিয়া পরিবার নিয়া চলতে পারি, মহল্লায় গেলে এই পরিবেশ পরিবর্তন করতে অইব। এহন একটা চহি আইন্যা হুইয়া থাহি, হেনতো একটা খাট কিনতে অইব। শোকেস, টিভি কিনতে অইব। মানে ওই জায়গার পরিবেশ মিলাইয়া চলতে অইব। এত টাকা কই পামু?’

ফোরন মিয়ার সঙ্গে কথা বলার সময় চারপাশে জড়ো হন বেশ কয়েকজন বস্তিবাসী। ফোরন মিয়া যখন কথা বলছিলেন, নীরব থেকে, মাথা নেড়ে, কখনও ‘হ’ জাতীয় ধ্বনি করে তারাও যেন একাত্মতা প্রকাশ করছিলেন।

লেক ঘেঁষে গড়ে ওঠা কড়াইল বস্তির একটি বাড়িতে থাকেন ঝরনা রানী। ১২ বছর ধরে তিনি এ বস্তিতে থাকছেন।  বলেন, ‘সব মিলাইয়া তিন হাজার টাকা ভাড়া পইড়া যায়। আড়াই হাজার টাকা ভাড়া। এত কম টাকায় ভাড়া আর কোথাও পাওয়া যাবে না। চইলা যামু কই? থাকতে তো অইবই ঢাকা। অন্য জায়গায় থাকলে কি এই ভাড়ায় থাকতে দিব? দিব না। এর চেয়ে বেশি লাগব। আমি ভাড়াই দিতে পারতেছি না এক বছর ধইরা। দিয়া, না দিয়া থাকতেছি। আমরা গরিবরা যে এই বস্তিডাত বাঁচতাছি, অনেক উপকার আমরার অইতাছে।’

পরিবারপ্রতি ৪৭ হাজার টাকা পাওয়া নিয়েও শঙ্কা

ঝরনা রানী আরও বলেন, ‘আমাদের সাথে কথা বলা হয় নাই। আমার কাছ থেকে ফোন নম্বর নিছে না। আমি জানি না।’

যদিও প্রকল্প পরিচালক আমিনুর রহমান সুমন বলেন, ‘এই তালিকা করার পেছনে সেনাবাহিনী, স্থানীয় কমিশনাররা প্রচণ্ড সহযোগিতা করেছেন। ঘরগুলোতে কে থাকেন, পরিবার প্রধানের নাম, তার ভোটার আইডি নম্বর, স্থায়ী ঠিকানা, মোবাইল নম্বর, যার ভোটার আইডি নেই তার জন্মসনদ– এসব তথ্য আমরা রেখেছি। আমরা একটা বিস্তারিত তালিকা করেছি। আমাদের কথা হচ্ছে, যিনি শিফট হবেন তিনিই এই টাকা পাবেন।’

এ বিষয়ে বিআইপির সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘নেতিবাচক দিক হচ্ছে, তিন হাজার ৬০২টি পরিবারকে ৪৭ হাজার টাকা দেয়া, এটা নিশ্চিত করা একটা বড় বিষয়। বাংলাদেশে বলা সহজ যে অসহায় পরিবার পাবে, কিন্তু দেখা যাবে অবৈধভাবে যে ভাড়া আদায় করে তারা বলবে যে, আমাকে ২০ শতাংশ দেন, ৫০ শতাংশ দেন বা পুরো টাকাই নিয়ে নিতে পারে। প্রকৃতপক্ষে বসবাসকারীদের কাছে এই টাকা পৌঁছানো বড় চ্যালেঞ্জ।’