আরসিবিসি–ফিলিপাইনের সুবিধাভোগীরা চুরিতে জড়িত

লেখক:
প্রকাশ: ৬ years ago

রিজার্ভের অর্থ চুরির মামলা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি বলেছেন, আরসিবিসি আমাদের ২০০ অনুচ্ছেদের জবাব দিক। ৪-৯ ফেব্রুয়ারি কেন আরসিবিসির সিসিটিভি বন্ধ ছিল। রোববার তাদের ব্যাংক বন্ধ থাকার পরও ভোরে কেন ব্যাংকটির সুইফট সার্ভার বন্ধ করা হলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিশোধ আদেশ বন্ধের বার্তা না পাওয়ার জন্যই তারা এ কাজ করেছে। এসব থেকেই বোঝা যায়, তারা এক জোট হয়ে এ চুরিতে জড়িত ছিল।

রিজার্ভের চুরি হওয়া অর্থ আদায়ে গত বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের সাউদার্ন ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে মামলা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। মামলায় ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনসহ (আরসিবিসি) ৭ প্রতিষ্ঠান ও ১৫ ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। এ ছাড়া মামলায় অজ্ঞাতনামা ২৫ জনকে আসামি করা হয়। এ নিয়ে রোববার এক সংবাদ সম্মেলন করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

সংবাদ সম্মেলনে আজমালুল হোসেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলা হয়েছে, কারণ সেখানে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হয়। মামলা স্বাভাবিক গতিতে চললে নিষ্পত্তি হতে ৩ বছর সময় লাগবে। মামলা নিয়ে অনেক আপত্তি আসবে। এর মধ্যে এসেছেও। আরসিবিসির আইনজীবী বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে মামলা করার অধিকার নেই। আমরা জানি এমন অভিযোগ আসবে, তা জেনেই দেশটিতে মামলা করা হয়েছে। ১০৩ পাতার ৪০০ অনুচ্ছেদের অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০০ অনুচ্ছেদই আরসিবিসির বিরুদ্ধে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনজীবী আরও বলেন, ‘আমাদের মামলা আরসিবিসি ও দেশটির বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তির বিরুদ্ধে। তারা জেনেশুনে চুরির টাকা ব্যবহার করেছে। ব্যবহারের সুযোগ করে দিয়েছে। তারা যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে জবাব দিক, চুরির টাকা তাদের কাছে কেন গেল। কেন ব্যবহারের সুযোগ করে দিল।’

ফিলিপাইনের আদালতে কেন মামলা করা হলো না, জানতে চাইলে আজমালুল হোসেন বলেন, ‘রিজার্ভ চুরি নিয়ে আমরা ফিলিপাইনের কাছে আইনি সহায়তা চেয়েছিলাম। ফিলিপাইনে এ নিয়ে কয়েকটি মামলাও চলছে। এর ফলে দেড় কোটি ডলার ফেরত এসেছে। পুরো টাকা ফেরাতে যদি আমরা ফিলিপাইনে মামলা করতাম, তা শেষ হতে ৩০ বছর সময় লেগে যেত। আমরা তো এত দিন অপেক্ষা করতে পারি না। এটা জনগণের টাকা। এ জন্য বিকল্প প্রক্রিয়া নিয়ে ২ বছর ধরে চিন্তা করেছি।’

মামলা দায়েরে ৩ বছর কেন লাগল জানতে চাইলে আজমালুল হোসেন বলেন, ‘তামাদি আইন বলে সব দেশে একটি আইন আছে। নিউইয়র্কের আইনে ৩ বছরের মধ্যে মামলা করার তাগিদ রয়েছে। আমরা এ সময়ের মধ্যেই মামলাটি করেছি। আমরা ২ বছর ধরে অন্য কোনোভাবে মামলা করার চেষ্টা করেছিলাম। নিউইয়র্ক ফেড ও সুইফটকে সঙ্গে নিয়ে মামলার চেষ্টা করা হয়েছে। কারণ আমরা তিন পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত। তবে তা হয়নি। মামলার বিভিন্ন নথি সংগ্রহ করতে সময় লেগেছে। যুক্তরাষ্ট্রের আইনজীবীদের ঠিক করতে হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের অনুমোদন লেগেছে, নিউইয়র্ক ফেডেরও অনুমোদন লেগেছে। তবে আমরা বর্তমানে যে অবস্থানে এসেছি, তা খুবই ভালো বলা যায়।’

সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান বলেন, ফিলিপাইন ও নিউইয়র্কে যেতে সরকারি নিয়ম মেনে খরচ হয়েছে। এখন পর্যন্ত খরচ বাংলাদেশি টাকায় সর্বোচ্চ ৩ কোটি হবে, এর বেশি নয়। দেশের টাকা ফেরত আনতে মামলা না করে জনগণের কাছে জবাবদিহি করা যাবে না। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকেও মামলা করতে বলা হয়েছে।

জানা যায়, হ্যাকাররা প্রায় ১০০ কোটি ডলার চুরি করার ষড়যন্ত্র করেছিল। তবে তারা ১০ কোটি ১০ ডলার চুরি করতে পারে। এর মধ্যে ২ কোটি ডলার শ্রীলংকার একটি অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা হয়। এর মধ্যে বানান ভুলের কারণে শ্রীলংকার অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করা অর্থ ফেরত আসে। ২০১৬ সালের আগস্টে ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক চুরির অর্থ স্থানান্তর বন্ধে ব্যর্থতার কারণে আরসিবিসি ব্যাংককে রেকর্ড পরিমাণ ১৯ মিলিয়ন ডলার বা ১ কোটি ৯০ লাখ ডলার জরিমানা করে।

২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অর্থ চুরির ঘটনা ঘটলেও তা প্রকাশ পায় মার্চে। এ ঘটনায় তৎকালীন গভর্নর আতিউর রহমানকে পদত্যাগ করতে হয়। দুই ডেপুটি গভর্নরকেও সরিয়ে দেয় সরকার। ঘটনা তদন্তে সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনকে প্রধান করে কমিটি করে সরকার। বারবার আশ্বাস দিলেও সেই প্রতিবেদন প্রকাশ করেননি সদ্য বিদায়ী অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।

২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ছিল বৃহস্পতিবার। পরের দুই দিন সরকারি ছুটি হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের হিসাব থেকে অর্থ বের করতে সেদিন রাতকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল। ওই রাতেই ১৯৩ কোটি ডলার বের করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে সব আদেশ কার্যকর না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত চুরি হয় ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার।

অর্থ স্থানান্তরের বার্তা আদান-প্রদানকারী আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক সেবাদাতা সংস্থা সুইফটকে (সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টার ব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন) হ্যাক করেই এ অর্থ চুরি করা হয়। সুইফটের মাধ্যমে অর্থ স্থানান্তরের কোনো আদেশ দেওয়া হলে তার একটি কপি স্বয়ংক্রিয়ভাবে আদেশদাতা প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট কম্পিউটারের মাধ্যমে প্রিন্ট হওয়ার কথা থাকলেও এ ক্ষেত্রে তা হয়নি। ফলে ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি এসব অর্থ পরিশোধের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জানতে চায় ফেড। এরপরই বিষয়টি জানতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক। তার আগেই অবশ্য তাৎক্ষণিকভাবে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার স্থানান্তর হয়ে যায়।

অর্থ স্থানান্তর হয়ে যাওয়ার পর ১১ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন গভর্নর আতিউর রহমান ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরকে ফোন করে অর্থ উদ্ধারের বিষয়ে সহায়তা চান। ১৪ ফেব্রুয়ারি ফিলিপাইনে যায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিনিধিদল। এরপর দফায় দফায় সরকারের মন্ত্রী, উপদেষ্টা, গভর্নরসহ আরও অনেকে অর্থ উদ্ধার নিয়ে ফিলিপাইন, সুইফট কর্তৃপক্ষ ও ফেডের সঙ্গে সভা করে। ঘটনার তিন বছরের মাথায় মামলাটি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এ ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে মতিঝিল থানায় করা মামলার তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। দায়িত্ব পাওয়ার পর সিআইডি বারবার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আদালতের কাছ থেকে সময় চেয়ে নিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরিসহ অর্থ পাচারের আট দফা অভিযোগে ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের (আরসিবিসি) সাবেক শাখা ব্যবস্থাপক মায়া সান্তোস দেগুইতোকে ৩২ থেকে ৫৬ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন দেশটির আদালত। প্রতিটি অভিযোগের জন্য মায়াকে চার থেকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সম্প্রতি আদালত এই দণ্ডাদেশ দেন বলে রয়টার্সের প্রতিবেদনে জানানো হয়।

এই চুরিকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সাইবার চুরির ঘটনা বলে মনে করা হয়। এ চুরিতে প্রথম সাজা পেলেন মায়া। কারাদণ্ডের পাশাপাশি মায়াকে ১০৩ মিলিয়ন ডলারের অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে।