‘আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মাহিবি আর তার মা আমাকে বাঁচতে দেয়নি। আমি বার বার মাহিবির কাছে কুত্তার মতো গেছি। অথচ সে আমাকে পায়ে ঠেলে তাড়িয়ে দিয়েছে। মাহিবির মা-বোন আমাকে যা-তা বলেছে। আমাদের রিলেশন এমন পর্যায় চলে গেছে যে আমি আর ফিরে আসতে পারলাম না। আব্বু-আম্মু আমাকে মাফ করে দিও। আমার লাশের আশপাশেও যেন মাহিবি আসতে না পারে।’
প্রেমিক মাহিবি ও তার মা-বোনকে দায়ী করে তিন পৃষ্ঠার এমন সুইসাইড নোট লিখে আত্মহত্যা করেন ইডেন কলেজের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী সায়মা কালাম মেঘা (১৯)।
গত রোববার সন্ধ্যায় ঢাকার কাঁঠালবাগান এলাকার ৭৪/১ ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের চারতলা বাড়ির চারতলার একটি কক্ষ থেকে গলায় ফাঁস লাগানো অবস্থায় মেঘার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এরই মধ্যে মেঘার সুইসাইড নোট উদ্ধার করে পুলিশ।
সুইসাইড নোটে মেঘা আরও লিখেছেন, ‘আল্লাহ মানুষকে মেয়ে দেয়। কিন্তু সবাইকে মেয়ে দেয়া উচিত নয়। আল্লাহ যাদের অনেক টাকা-পয়সা দেয়, শুধু তাদেরই যেন মেয়ে দেয়। তাহলে আমার মতো গরিবের মেয়ে নিয়ে ওরা খেলতে পারবে না।’
আত্মহত্যার আগে নিজের বাবা-মা ও ভাইকে উদ্দেশ করে মেঘা সুইসাইড নোটে লিখেছেন, ‘আম্মু আমি জানি আমি ছাড়া তোমার আর কেউ নেই। কিন্তু আজ আমি নিরুপায়। তুমি মুক্তা চাচিকে জিজ্ঞেস করে দেখিও আমার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। তাই আজকে আমি আত্মহত্যা করলাম। আমার ভাইকে মানুষের মতো মানুষ করিও, যেন আমার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে পারে। আর মা তুমি, আব্বুকে সামলাইও। আব্বুকে বুঝাইও, আমি নিরুপায় হয়ে আত্মহত্যা করেছি। ইতি মেঘা।
জানা যায়, তিন বছর ধরে ইডেন কলেজের ছাত্রী ঝালকাঠির সায়মা কালাম মেঘার সঙ্গে বরিশাল হাতেম আলী কলেজের ছাত্র ঝালকাঠির মাহিবি হাসানের প্রেমের সম্পর্ক। প্রেমের সম্পর্কের সূত্র ধরে তারা পারিবারিকভাবে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলেও বাধা হয়ে দাঁড়ান মাহিবির মা সেলিনা বেগম। তিনি কোনোমতেই মাহিবি মেঘার সম্পর্ক মেনে নেননি। মায়ের বাধায় প্রেমিকা মেঘাকে বিয়ে করতে টালবাহানা শুরু করেন মাহিবি।
একাধিকবার বিয়ের দিন নির্ধারণ আবার পরিবর্তন করে নতুন কৌশল অবলম্বন করেন মাহিবি ও তার পরিবার। বিষয়টি নিয়ে প্রেমিক মাহিবির সঙ্গে একাধিকবার বাগবিতণ্ডা হয় মেঘার। রোববারও (২১ এপ্রিল) বিষয়টি নিয়ে তাদের মধ্যে তর্কাতর্কি হয়। একপর্যায়ে প্রেমিককে ভিডিও কলে রেখে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন প্রেমিকা মেঘা।
ভিডিওতে প্রেমিকার করুণ মৃত্যু দেখেও মন গলেনি প্রেমিক মাহিবির। প্রেমিকার মৃত্যুর পর সহপাঠী আফরিন জাহান ও মেঘার মা রুবিনা আজাদকে ফোন দিয়ে মৃত্যুর বিষয়টি জানান মাহিবি।
এ ঘটনায় গত বৃহস্পতিবার দুপুরে ঝালকাঠি শহরের পূর্ব চাঁদকাঠির বাড়িতে সংবাদ সম্মেলন ডেকে মেয়ের আত্মহত্যার বর্ণনা দেন মেঘার বাবা-মা। এ সময় লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন তার চাচা আবুল বাশার। সংবাদ সম্মেলনে মেঘার মা রুবিনা আজাদ, বাবা আবুল কালাম ও চাচাতো ভাই মাইনুল হোসেন উপস্থিত ছিলেন।
সোমবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে মেঘার মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে পুলিশ। মঙ্গলবার দুপুরে ঝালকাঠি শহরের মুসলিম পৌর কবরস্থানে তার লাশ দাফন করা হয়।
এ ঘটনায় রোববার রাতেই কলাবাগান থানায় মামলা করেন মেঘার চাচা আবুল বাশার। মামলায় তিনি উল্লেখ করেছেন, ঝালকাঠি শহরের পূর্ব চাঁদকাঠি এলাকার মাহিবি হাসানের (২৫) প্ররোচনায় গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে মেঘা।
আত্মহত্যার কারণ হিসেবে মেঘার বাবা আবুল কালাম আজাদ বলেন, মাহিবির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে মেঘার। ২০১৭ সালে মেঘা ঢাকার ইডেন কলেজে ভর্তি হয়। ঢাকায় গিয়ে মাহিবি প্রায়ই মেঘার সঙ্গে দেখা করতো। মাস ছয়েক আগে মেঘা এবং মাহিবি বিয়ের ব্যাপারে একমত হন। কিন্তু এতে বাধা হয়ে দাঁড়ান মাহিবির মা ঝালকাঠির কীর্ত্তিপাশা হাসপাতালের নার্স সেলিনা বেগম। শবে বরাতের দুদিন আগে কাউকে না জানিয়ে ঢাকায় তাদের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। এজন্য মেঘা কিছু কেনাকাটাও করেছিলেন। কিন্তু মাহিবি ওইদিন কথা দিয়ে বিয়ের জন্য আসেনি। এ নিয়ে মোবাইলে তাদের ঝগড়া হয়। রোববার বিকেলে মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগেও মেঘা এবং মাহিবির ইমোতে কথা হয়। ভিডিও কলে কথা বলার সময়ই মেঘা তার প্রেমিক মাহিবিকে বলেছেন, যদি বিয়ে না করো তাহলে এখনই আমি আত্মহত্যা করব। পরে মাহিবিকে ভিডিও কলে রেখে ফ্যানের সঙ্গে ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে মেঘা।
কলাবাগান থানা পুলিশের এসআই মো. সেলিম রেজা বলেন, মেঘার চাচা যে মামলা করেছেন সেটির তদন্ত চলছে। মেঘার আত্মহত্যার পেছনে কারও প্ররোচনা থাকলে তা তদন্তে বেরিয়ে আসবে। দণ্ডবিধির ৩০৬ ধারায় আত্মহত্যায় প্ররোচনাকারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়া হবে। এরই মধ্যে মেঘার সুইসাইড নোট পাওয়া গেছে।