‘আমার পোলা কই? অগো না আজকা আওয়ার কতা?’ কাউকে দেখলেই মা ফিরুজা বেগম (৫৫) তার দিকে ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে থেকে ভাঙা গলায় জিজ্ঞেস করছেন। আবার বাড়ির কাজের মেয়েকে বারবার ডেকে বলে উঠছেন, ‘ফারুকের (প্রিয়ক) ঘরটা পরিষ্কার কইরা রাখ, ওরা আজকা আইব।’
কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দরে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত প্রিয়কের মা চার দিনেও জানেন না, তার একমাত্র ছেলে এবং নাতনি আর কোনোদিনই আসবেন না। ঘরদোর যতই পরিস্কার করা হোক, সেখানে তাদের পা পড়বে না আর কখনই।
সাহস করে সন্তান আর নাতনির এমন মৃত্যুর সংবাদ এখনও কেউ তাকে দিতে পারেননি। তিনি শুধু জানেন, তারা একটু আহত হয়েছেন। নেপালের কাঠমান্ডুতে ইউএস-বাংলার দুর্ঘটনাকবলিত উড়োজাহাজে নিহত ফটোগ্রাফার এফ এইচ প্রিয়ক ও তার শিশুকন্যা প্রিয়ন্ময়ীর লাশ আনতে বড় দুই ভাই মঙ্গলবার থেকেই কাঠমান্ডুতে অবস্থান করছেন। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, ত্রিভুবন ইউনিভার্সিটি টিচিং হাসপাতালে প্রিয়ক ও তার সন্তানের লাশ শনাক্ত করতে হাসপাতালের সামনে চার দিন ধরেই অপেক্ষমাণ তারা। কিন্তু কোনোভাবেই লাশ দেখতে পারছেন না।
বৃহস্পতিবার দুপুরে গাজীপুরের শ্রীপুরের নগর হাওলা গ্রামে প্রিয়কের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, অসুস্থ মা বিছানায় স্বজনদের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছেন। কোথাও একটা বড় কোনো ক্ষতি হয়ে গেছে, তার আঁচ পাচ্ছেন যেন। কখনও অস্থির, কখনও একেবারেই শান্ত।
বাড়িতে ঢুকতেই দেখা হয় গৃহকর্মী ছবি বেগমের সঙ্গে। অশ্রুসজল চোখে ছবি বলেন, সোমবার ফজর নামাজ পড়েই ফিরুজা বেগম তার নাতনি প্রিয়ন্ময়ীকে গোসল করান। প্রতিদিন গোসলের সময় প্রিয়ন্ময়ী কান্না করত। কিন্তু সেদিন সে কান্না করেনি। গোসল করাতে করাতে নাতনিকে বলেছিলেন, ‘দাদু, তুমি তো বিমানে উড়বা, অনেক দূরে যাইবা, কত্ত মজা করবা, আমার জন্য কী আনবা?’ গোসল শেষে নাতনিকে চুল আঁচড়ে তৈরি করিয়ে দেন। বাড়ি থেকে ভোর সাড়ে ৬টায় বের হন প্রিয়ক, এ্যানি, প্রিয়ন্ময়ী আর প্রিয়কের চাচাতো ভাই মেহেদী হাসান মাসুদ ও ভাবি স্বর্ণা। গাড়িতে ওঠার আগে ফিরুজা বেগম প্রত্যেকের কপালে চুমু দিয়ে দোয়া করেন। মা বলেছিলেন, ‘বাবা, বিমানে ওঠার আগে আমাকে কল দিস।’ ছেলে প্রিয়ক আর কল দিতে পারেননি।
নেপালের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মেহেদী হাসান বৃহস্পতিবার টেলিফোনে প্রিয়ন্ময়ী সম্পর্কে বলেন, প্রিয়ন্ময়ী বিমান দেখে এত খুশি হয়েছিল! প্লেনে ওঠার আগে বিমানবন্দরে অপেক্ষাগারের পাশের একটি জানালা দিয়ে প্রিয়ন্ময়ী বিমান দেখছিল। তাকে সেখান থেকে আনাই যাচ্ছিল না। সে ওই জানালার পাশে অনেকক্ষণ খেলা করেছে। বিমানে ওঠার পর ভাইয়া (প্রিয়ক) কেমন যেন নীরব হয়ে গিয়েছিল। একবার শুধু ভাইয়া ভাবিকে বলেছিল, ‘দোয়া পড়ো।’
গত সোমবার ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়, ওই বিমানের যাত্রী ছিলেন গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার নগরহাওলা গ্রামের একই পরিবারের পাঁচ সদস্য। দুর্ঘটনায় শিশু প্রিয়ন্ময়ী ও তার বাবা এফ এইচ প্রিয়ক নিহত হন। গুরুতর আহত হন প্রিয়কের স্ত্রী এ্যানি, মেহেদী হাসান ও তার স্ত্রী স্বর্ণা। তারা কাঠমান্ডুতেই চিকিৎসাধীন আছেন। আজ তাদের দেশে ফিরে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।