অরিত্রির কক্ষের ফ্যানটি গত পরশু থেকে একবারও ঘোরেনি। ওই ফ্যানেই ঝুলে আত্মহত্যা করে অভিমানী মেয়েটি। যে পাখাগুলো ঘুরে ঘুরে প্রাণ জুড়িয়ে দিত, সেই পাখাগুলো নিষ্ক্রিয়, নিথর হয়ে আছে অরিত্রির ঝুলে থাকা দেহের মতোই।
বাবা দিলীপ অধিকারী নির্বাক হয়ে ফ্যানের দিকে তাকিয়ে রইলেন খানিক সময়। চোখ ছল ছল। বুকের দহন ঠোঁট বেয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ঠোঁট কামড়ে ধরে বুকের জ্বালা সামলানোর চেষ্টা করলেন। ধরে আসা গলায় মৃদু স্বরে বললেন, ‘তোমরা ফ্যানটি খুলে ফেল। ঘরে আসলেই চোখে ভেসে ওঠে, আমার অরিত্রি বুঝি ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আছে।’
কক্ষের দক্ষিণ-পূর্ব কর্নারে ড্রেসিংটেবিল। তাতে অরিত্রির গিটারটি রাখা। গিটারের ছয়টি তার যেন হুহু করে কাঁদছে। গেল দু’দিনে কেউ হাত রাখেনি গিটারে। বাবা দিলীপ অধিকারীর কান্না, ‘আমার অরিত্রির গিটার কী আর বাজবে না!’ দিলীপ অধিকারীর কান্নায় কাঁদলেন তখন অন্যরাও।
বুধবার বিকেলে শান্তিনগরে অরিত্রি অধিকারীর বাসায় ‘শান্তিনিবাস’-এ গেলে বাবা দিলীপ অধিকারী এবং মা বিউটি অধিকারী মেয়ের স্মৃতিচারণ করেন। এ সময় পুরো বাড়িতে এক আবেগঘন পরিবেশ তৈরি হয়।
দিলীপ অধিকারী বলেন, আমার মেয়ে সবসময় মেধাতালিকায় দশের মধ্যে থাকত। এরপরও ভুল করতে পারে। আমি প্রিন্সিপালকে করজোড়ে বললাম, মেয়ে দোষ করলে যেকোনো শাস্তি দিন। তবে অনুরোধ করছি, টিসি (বহিষ্কার) দিয়েন না। ওর মা অসুস্থ। সেও এসেছে। মেয়েকে টিসি দিলে সইতে পারবে না। আমার আরেক মেয়ে পড়ে আপনার এখানেই। আবার ভুল করলে দুই মেয়েকেই আমি নিয়ে যাব। একবারের জন্য ক্ষমা করেন। আমাদের তিরস্কার করে প্রিন্সিপালের কক্ষ থেকে বের করে দিল। অরিত্রির মাকে বসতেও বলল না।
তিনি বলেন, আমাদের অপমান করার বিষয়টি কিশোরী মেয়ে মানতে পারেনি। এরপর কেমনে পালিয়ে চলে আসে কেউ বুঝতে পারিনি। স্কুলে অনেক খোঁজার পর বাড়িতে চলে আসি। এর মধ্যে যা হবার তা হয়ে গেছে। মেয়ে আমাদের একটুও সময় দেয়নি।
অরিত্রির বাবা আরও বলেন, ‘আমার মেয়ে ভাইস প্রিন্সিপালের পা ধরতে গিয়েছিল। কিন্তু ওকে পা ছুঁতে দেয়নি। শিক্ষক হচ্ছেন বাবার মতো। সেই শিক্ষক কী করে এত নিষ্ঠুর হয়, তা নিজ চোখে না দেখলে বুঝতে পারতাম না। ও ভর্তি পরীক্ষায় পঞ্চম হয়েছিল। অথচ সামান্য নকলের অভিযোগে টিসি…।’
তিনি বলেন, শিক্ষকের পাষণ্ডতায় আর কোনো প্রাণ ঝরে না যাক, আমি সেই প্রত্যাশা করছি মেয়েকে হারিয়ে। আর আমার মেয়েকে যারা আত্মহত্যা করতে বাধ্য করল, তাদের উপযুক্ত শাস্তির মধ্য দিয়েই সকলের বোধ ফিরে আসুক।
অরিত্রির মা বিউটি অধিকারী ঘরের সবকিছু ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছিলেন প্রায় বাকরুদ্ধ হয়ে। অরিত্রি কোরিয়া পোশাক আর সাজ পছন্দ করত। ছবিও তুলত কোরিয়া মেয়েদের ঢংয়ে। ইংরেজি নভেল পছন্দ ছিল অরিত্রির। বুকসেলফে হাত রেখে রেখে মেয়ে হারানোর বেদনা তিনি প্রকাশ করছিলেন অশ্রুসিক্ত চোখে।
মা বিউটি অধিকারী বলেন, ওর ছোট্ট জীবনের এত গল্প আমি কী করে সামলে রাখব। এত দুঃখ আমি কী করে সইব। ওর স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হবে। আমি এখন কাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখব!