#

আমতলীর কালিবারি গ্রামের দেলোয়ার কবিরাজ, হাই সরদার কাউনিয়া গ্রামের ইলিয়াস মাতুব্বর ও কেওয়া বুনিয়া গ্রামের ছত্তার গাজী ড্রাগন চাষ করে তাদের ভাগ্য বদল করেছেন। তাদের দেখা দেখি গ্রামে এখন অনেকেই ড্রাগন চাষের দিকে ঝুঁকছেন।

আমতলী উপজেলার গুলিশাখালী ইউনিয়নের কালিবারী গ্রামের এক সময়ের দিন মজুর অভাবী দেলোয়ার কবিরাজ ড্রাগন চাষ করে সংসারের অভাব ঘুচিয়ে এখন স্বাবলম্বী। ৫ বছর অগেও ছিল দেলোয়ার দিন মজুর।

সংসার চালানোর জন্য এবং ছেলে মেয়েদের মুখে কয়েকটা ভাত তুলে দিতে মানুষের বাড়িতে কাজ করে যা সামান্য পাওয়া যেত তা দিয়ে তিন ছেলে মেয়ে এবং স্ত্রীর ভরন পোষন চালাতেন। যখন কোন কাজ পাওয়া যেত না তখন পুরো পরিবারকে উপোষ করে কাটাতে হত।

এভাবেই সংসার চলার পর ২০১৫ সালের কোন এক সময় একটি এনজিওর প্রশিক্ষনে গিয়ে ড্রাগন ফলের নাম শুনেন এবং এর চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে ধারনা লাভ করেন।

বাড়িতে এসে পরের দিন মাত্র ২০টি চারা সংগ্রহ করে বাড়ির আঙ্গিনায় চাষ করে অন্যের বাড়ির কাজের শেষে রাতে বাড়ি ফিরে নিজের লাগানো ড্রাগন ফলের পরিচর্জা করতেন।

এভাবেই বছর পার হওয়ার পর গাছ জুরে আসে ফুল আর ফল। প্রথম বছর ড্রাগন বিক্রি করে লাব হয় ১০ হাজার টাকা। টাকা হাতে পেয়ে আনন্দ্রে আত্মহারা হয়ে যান দেলোয়ার গাজী। অন্যের বাড়ির কাজ ছেরে পরের বছর ৩ হাজার টাকায় জমি বন্ধক রেখে ড্রাগন ফলের পরিধি বাড়িয়ে গাছের সংখ্যা করেন দেড়’শ।

এভাবে বাগানে ড্রাগন গাছ বাড়তে বাড়তে বর্তমানে দেলোয়ার হোসেনের বাগানে ৭’শ ড্রাগন ফলের গাছ রয়েছে। এর মধ্যে লাভের টাকা দিয়ে ৬ বিঘা জমি ক্রয় করেছেন। বন্ধক রেখেছেন আরো ৬বিঘা। ক্রয় করা জমিতে গরে তুলেছেন এক সমন্বিত ফলজ আর ওষধি গাছের সমাহার।

শুক্রবার সকালে দেলোয়ার হোসেনের ড্রাগনের বাগন সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সারি সারি ড্রাগন গাছ। গাছে গাছে ফুল আর ফল ঝুলছে। পাশেই মাল্টা, লটকন, জামরুল, আম্্রপলি,আমড়া, কাঠলিচু, ফিউজাই ফল, পেয়ারা আর সারি সারি পেঁপেঁ ভর্তি গাছ দারানো।

পাশেই রয়েছে ঔষুধী গাছ ফনিমনসা, শতমুল, তালমুলী, দন্তশুল, বাবুল তুলসী, বিহিরিঙ্গী রাজসহ নানা জাতের ঔষুধী গাছে ভরপুর পুরো বাগান। বাগানে কাজ করেন দেলোয়ার কবিরাজ স্ত্রী রাবেয়া খাতুন এবং ছেলে মিরাজুল ইসলাম। প্রতিমাসে তার বাগান থেকে এখন আয় হয় প্রায় ৪০-৫০ হাজার টাকা।

সংসারের সকল অভাব দুর হয়ে এখন শুধু সুখ আর সুখ। দেলোয়ার কবিরাজের স্ত্রী রাবেয়া বেগম বলেন,‘কোন দিন প্যাট ভইর‌্যা ভাত খাইতে পারি নাই। মোরা এই বাগান হইর‌্যা অনেক টাহা লাভ পাইছি। হেইয়া দিয়া মোগো এহন অনেক জাগা জমি অইছে। মোরা এহন পোলা মাইয়া নাতি নাতনি লইয়া ব্যামালা ভাল আছি।’

ছেলে মিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘অগে ব্যামালা কষ্ট হরছি। মানসের কাম হরছি। কোন রহম ভুল অইলে মাইনসে একছের গালাগালি দিত। এহন মোরা এই ড্রাগনের গাছ লাগাইয়া অনেক ভালো অইছি। আল্লায় মোগো অনেক ভালো রাখছে।’

দোলোয়ার কবিরাজ বলেন, ‘জীবনভর মুই মানসের কাম হরছি। পহেলা জীবনে ১স্যার চাউলেও কাম হরছি। হেই চাউল দিয়া কোন রহম পোলা মাইয়া বউ লইয়া দিন কাডাইছি। কাম না পাইলে উপাস্যা দিন কাডাইছি।

মুই একটা মির্টিং এ যাইয়া ড্রাগন লাগাইলে ব্যামালা লাভ হুউন্যা বাড়ি অইয়া ২০ডা চারা লাগাইয়া শুরু হরছি।

এহন মোর বাগানে ব্যামালা চারা। এহন মুই এই ড্রাগনের বাগান দিয়া ব্যামালা লাভবান অইছি। মোর অনেক জাগা জমি অইছে। সংসারে আয় ব্যামালা বাড়ছে।

মাসে এহন প্রায় ৪০-৫০ আজার টাহা আয় হরি। টাহার অভাবে পোলা মাইয়াগো ল্যাহা পরা হরাইতে পারি নাই। তয় পোলার ঘরের নাতি রাজুরে এহন ভাল হইর‌্যা লেহা পরা হরাইতে চাই।’

কালিবাড়ি গ্রামের আরেক ড্রাগন চাষী আব্দুল হাই সরদার। মাত্র ৩০টি চারা দিয়ে শুরু করে তার বাগানে এখন প্রায় ৩৩ শতাংশ জমির ৩টি বাগানে প্রায় ৬ শতাধিক চারা রয়েছে। এক সময়ের অভাবী চাষী হাই সরদার এখন বছরে প্রায় ২ থেকে আড়াই লাখ টাকা আয় করেন ড্রাগন ফল বিক্রি করে। তার এ কাজে সহায়তা করেন ছেলে হালিম ও সোহেল সরদার। ড্রাগন চাষ করে তার ভাগ্য বদল করেছেন।

এক সময় টাকার অভাবে ছেলেদের লেখা পরা করাতে না পারলেও ড্রাগন চাষের আয় দিয়ে এক মাত্র মেয়েকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে প্রায় ৩ লাখ টাকা খরচ করে বিয়ে দিয়েছেন। ড্রাগনের আয় দিয়ে বাড়িতে দ্বিতলা টিন সেডের ঘর তৈরী এবং পুকুর করে মাছ চাষও করেছেন।

ক্রয় করেছেন ৩০ শতাংশ জমিও। এখন আর তার সংসারে অভাব নেই। ছেলে মেয়ে নতি নাতনিদের নিয়ে অনেক সুখেই আছেন আব্দুল হাই সরদার। তার সাথে কথা হয় তার বাড়িতে। তিনি বলেন, ‘আমি এক সময় গরীব চাষী ছিলাম।

আমতলী কৃষি অফিসের মাধ্যমে প্রশিক্ষন পেয়ে মাত্র ৩০ টি চারা দিয়ে শুরু করা আমার বাগানে এখন প্রায় ৪শতাধিক ড্রাগন চারা রয়েছে। নিজেদের খাওয়া এবং আত্মীয় স্বজনদের দেওয়ার পরও বছরে প্রায় ২ থেকে আড়াই লাখ টাকার ড্রাগন ফল বিক্রি করি। আমার সংসারে এখন আর অভাব নেই। আমি এখন অনেক ভালো আছি।’

কুকুয়া ইউনিয়নের আরেক ড্রাগন চাষী আব্দুর ছত্তার গাজী। শখের বসে ড্রাগন চাষ করে এখন একজন সফল চাষী। বছরে আয় করেন দেড় থেকে দুলাখ টাকা। ২০১৯ সালে পুকুর পারের ১০ শতাংশ জমিতে মাত্র ৩২ টি চারা দিয়ে শুরু করা বাগানে এখন প্রায় ৪শতাধিক চারা রয়েছে।

মাসে প্রায় ২ মন ড্রাগন ফল আসে তার বাগানে। প্রতিমন ফল বিক্রি করেন ৮ হাজার টাকা করে। ছেলে দুয়ারিপারা সরকারী কলেজের বিসিএস ক্যাডারের প্রভাষক মো. নাসির মাহমুদ এর অনুপ্রেরনায় ড্রাগন চাষ করে সফলতা পেয়েছেন। তার এ কাজে সহায়তা করেন ছেলে বশির গাজী।

আব্দুল হাই সরদার বলেন, ‘আমার ছেলে নাসির উদ্দিন মাহমুদ এর অনুপ্রেরনায় ৩২ টি চারা দিয়ে শখের বসে ড্রাগন চাষ শুরু করি। এখন আমার বাগানে প্রায় ৩ শতাধিক ড্রাগন চারা রয়েছে।

বছরে প্রায় দেড় থেকে দুই লাখ টাকা আয় করি।’ ছত্তার গাজীর ছেলে মিরপুর দুয়ারিপারা সরকারী কলেজের প্রভাষক নাসির উদ্দিন মাহমুদ বলেন,‘চাকরির সুবাদে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে ড্রাগন চাষ দেখে উদবুদ্ধ হই।

আমার মনে এ ফল চাষের বাগান গড়ার ইচ্ছা থেকে বাবা এবং ভাইয়ের মাধ্যমে বাড়ির পুকুর পারে প্রথম চাষ করে সফলতা আসায় এখন বানিজ্যিক ভাবে চাষ করছি। এ ফল চাষ করে অনেক লাভ হচ্ছে। সবাই যদি এভাবে বাড়ির আঙ্গিনায় পরিত্যাক্ত জমিতে ড্রাগন চাষ করে তাহলে স্বাবলম্বী হওয়া সম্ভব।

আরেক টগবগে শিক্ষিত তরুন ইলিয়াস মাতুব্বর চাকরির চিন্তা বাদ দিয়ে ড্রাগন চাষ করে এখন স্বালম্বী। আমতলী পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা ইলিয়াস চাওড়া ইউনিয়নের কাউনিয়া গ্রামে ২০১৮ সালে ৯ বিঘা জমি লিজ নিয়ে ৯ লক্ষ টাকা খরচ করে ড্রাগন চাষ করেছেন।

পাশাপাশি তিনি তার বাগানে মাল্টা, পেয়ারা, আম ও পুকুর কেটে তাতে দেশীয় শিং মাছ চাষ করে এখন এলাকায় অনুকরনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। ইলিয়াস বলেন, বাগানে ৪শ’ ড্রাগন গাছ রয়েছে। ফলনও ভালো। তিনি আরো বলেন, শহরের জীবন এবং চাকরির চিন্তা বাদ দিয়ে আমি ড্রাগন, পেয়ারা, আম, মাল্টা ও মাছ চাষ করে মাসে এখন প্রায় ৫০ হাজার টাকা আয় করি।

আশা করি ভবিষ্যতে আয় আরো বাড়বে। আমতলী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সিএম রেজাউল করিম বলেন, ‘ড্রাগন চাষ একটি লাভ জনক ফল। ড্রাগন ফল বিদেশী হলেও আমাদের এ অঞ্চলে এর প্রচুর চাহিদা রয়েছে।

অল্প খরচে এ ফল চাষে লাভ অনেক বেশী। তাছাড়া এ ফল চাষে কোন কীটনাষক প্রয়োজন হয় না। শুধু বাগান করে এর সঠিক পরিচর্যা করলে অনেক ফল পাওয়া যায়।’

উত্তর দিন

Please enter your comment!
এখানে আপনার নাম লিখুন