শেষ পর্যন্ত ব্যবধান ২৫ রানের; কিন্তু শুরুতে দু’দলের অবস্থান ছিল প্রায় কাছাকাছি। দু’দলই শুরুতে চাপে ছিল। আফগানরা ৫.৫ ওভারে ৪০ রানে হারিয়েছিল ৪ উইকেট। আর টাইগারদের ৪ উইকেট খোয়া গেল ৩২ রানে।
সেই চাপের মুখে খেই না হারিয়ে সাহসী যোদ্ধার মত লড়াই করলেন দুই আফগান মোহাম্মদ নবি এবং আসগর আফগান। ৬ ওভার পুরো খেলা হয়নি। অথচ চার চারজন ফ্রন্টলাইন ব্যাটসম্যান সাজঘরে। পাড়ি দিতে হবে কঠিন পথ। যেতে হবে বহুদুর। আগে উইকেটে থিতু হই, তারপর হাত খুলে খেলবো।
এই চিন্তায় তেড়েফুঁড়ে অযথা ঝুঁকিপূর্ণ শট খেলা বাদ দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ খেললেন ঠান্ডা মাথায় যতটা সম্ভব সোজা ব্যাটে। একবারের জন্য রিভার্স সুইপ, স্কুপ বা অন সাইডে সরে, অফে জায়গা বানিয়ে খেলার চেষ্টা না করে আগে উইকেটে সেট হলেন, তারপর খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসে হাত খুলে মারলেন। এভাবে খেলে খেলেই মোহাম্মদ নবি আর আসগর আফগান পঞ্চম উইকেটে তুলে দিলেন ৬৭ বলে ৭৯ রান।
আসগর ৩৭ বলে ৪০ রানে আউট হলেও নবি একদিক আগলে থাকলেন শেষ পর্যন্ত। ৪১ বলে হাফ সেঞ্চুরি পূর্ণ করা নবী পরের ১৩ বলে ৩০ রান তুলে নট আউট ৮৪ রানে। তার চওড়া ব্যাটেই আফগানিস্তানের রান গিয়ে ঠেকলো ১৬৪’তে।
প্রায় একই অবস্থায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশও। কিন্তু তারা থামলো ১৩৯ রানে। পার্থক্যটা কোথায় শুনবেন? তাহলে দেখে নিন ছোট্ট এক পরিসংখ্যান- ১০ ওভার শেষে আফগানিস্তানের রান ছিল ৪ উইকেটে ৬০। একই সময় বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৪ উইকেটে ৫৯। মাত্র ১ রানের ফারাক।
সেখান থেকে ১৫ ওভার শেষে রশিদ খান বাহিনীর রান ৪ উইকেটে ১০৯। আর বাংলাদেশ ১৫ ওভার শেষে ৬ উইকেটে ৯৭। কাজেই বোঝাই যাচ্ছে, ঠিক এই জায়গায় ম্যাচ হাতছাড়া হয়েছে টাইগারদের। চাপের মুখে রয়ে-সয়ে উচ্চাভিলাসি ও ঝুঁকিপূর্ণ শট খেলা বাদ দিয়ে বেশি উইকেট হাতে রেখে শেষ চার-পাঁচ ওভারে স্লগ করার চিন্তায় না খেলে এলোমেলো লক্ষ্য ও বলগাহীন ব্যাটিংয়ের করুণ পরিণতি হলো এই পরাজয়।
বাংলাদেশ ব্যাটিংয়ে। নবি ও আসগররা যেখানে সোজা ব্যাটে খেলে খেলে রানের চাকা সচল রেখে একটা পর্যায়ে গিয়ে তারপর স্লগ করলেন। সাত-সাতটি ছক্কাও হাঁকালেন নবি। সেখানে বাংলাদেশের মুশফিক, লিটন, সাকিব, মাহমুদউল্লাহ, সৌম্য ও সাব্বির- সবাই শুরু থেকে অদ্ভুত তাড়াহুড়ো করলেন।
আর আফগান স্পিনার মুজিবুর রহমান-রশিদ খানের বিপক্ষে প্রায় সবাই সোজা ব্যাটে না খেলে রিভার্স সুইপ, স্কুপ ক্রস ব্যাটে খেলতে গেলেন। তাতেই পরিণতি হলো করুণ।
প্রথমে ভুল পথে হাঁটলেন মুশফিকুর রহীম। ইনিংসের সূচনা করতে গিয়ে দারুণ কাভার ড্রাইভে বাউন্ডারি হাঁকানোর ঠিক পরের বলে রিভার্স সুইপ খেলতে গিয়ে হলেন বোল্ড। মুশফিকের আগে ভুল পথের যাত্রী হলেন আরেক ওপেনার লিটন দাস। অফ স্পিনার মুজিবুর রহমানের ব্যাটে অনসাইডে খেলতে গিয়ে ক্যাচ দিলেন অফসাইডে।
ওয়ান ডাউনে নামা অধিনায়ক সাকিবও আগে থেকে সরে মারতে গিয়ে আর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেননি। ক্যাচ তুলে দিলেন মিড অনে আফগান অধিনায়ক রশিদ খানের হাতে।
চার নম্বরে নেমে অভিজ্ঞ মাহমুদউল্লাহ খেললেন ৪৪ রানের (৩৯ বলে) এক ইনিংস। দেশের হয়ে বেশ কিছু ভাল ও ম্যাচ জেতানো ইনিংস উপহার দেয়া রিয়াদ হয়তো আজকের এ ব্যাটিংটা ভুলে যেতে চাইবেন। চোখে মুখে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা। আর ব্যাটিংয়েও কি এক অস্বাভাবিক অ্যাপ্রোচ।
দীর্ঘ অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে কোথায় ধরে খেলবেন, বিপর্যয় এড়াতে সিঙ্গেলস-ডাবলসে রানের চাকা সচল রেখে একটা পর্যায়ে গিয়ে তারপর হাত খুলবেন; তা না, শুরু থেকে মরিয়া হয়ে খেলার চেষ্টা। এরপর সাব্বিরও তাই করলেন। বার বার রিভার্স সুইপ খেলতে গেলেন।
সৌম্য সরকারের অবস্থা ছিল সবচেয়ে খারাপ। অফ স্পিনার হলেও গুগলি এবং দুসরাসহ বৈচিত্র্যে ভরা মুজিবুর রহমানের স্পিন ভেলকিতে কি করবেন, যেন বুঝে উঠতে কষ্ট হচ্ছিল। বলের ডিরেকশন না বুঝে তাই লেগবিফোর উইকেটের ফাঁদে জড়ালেন।
আগের দিনের হিরো আফিফ হোসেন ধ্রুবও আজ আর সুবিধা করতে পারেননি। ১৪ বলে ১৬ রানে লং অফে ঠিক সীমানার ওপরে ক্যাচ দিয়ে ফিরে গেছেন।
আসলে পার্থক্যটা শুধুই ২৫ রানের নয়। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে আফগানরা টাইগারদের চেয়ে শুধু র্যাংকিংয়ে নয়, শক্তি, সামর্থ্য, আত্মবিশ্বাস, আস্থা, অ্যাপ্রোচ ও অ্যাপ্লিকেশন- সব কিছুতে এগিয়ে। রশিদ খানরা দল হিসবে যতটা পরিপাটি আর কার্যকর ক্রিকেট খেলেছে, সাকিব বাহিনী ঠিক ততটাই অগোছালো, অবিন্যস্ত।
বিশেষ করে ব্যাটিংয়ে। কারো ব্যাটে আস্থা, আত্মবিশ্বাসের ছিঁটেফোটাও ছিল না। কখন কি করতে হবে, কোন শট খেলতে হবে, কোন পরিস্থিতিতে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে হবে- তা যেন ভুলে গুলে খেয়ে ফেলেছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা।
উইকেটে গিয়ে যে যার মত করে ব্যাট চালিয়েছেন। টি-টোয়েন্টি মানেই তুলে মারা নয়। রিভার্স সুইপ খেলাও নয়। তা কারো মাথায় নেই। সোজা ব্যাটে খালি জায়গায় বল ঠেলেও যে রান করা যায়, তা বুঝি কারো মাথায়ই ছিল না। অথচ আফগানরা যেমন উইকেটে একটু ধাতস্ত হলে তারপর বিগ হিট নিয়েছেন অবলিলায়, সেখানে টাইগাররা একজনও তা পারেননি।
পুরো ইনিংসে ব্যাটসম্যান নামধারি কেউ ছক্কাও হাঁকাতে পারেননি। একমাত্র ছক্কা এসেছে ১১ নম্বর ব্যাটসম্যান মোস্তাফিজের ব্যাট থেকে। আসলে শ্রী-হীন, এলোমেলো আর অপরিকল্পিত ক্রিকেট খেলে আফগানদের হারানো সম্ভব নয়- রাতে হোটেল কক্ষে শুয়ে নিশ্চয়ই টাইগাররা তা অনুভব করছেন!