আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রধান প্রসিকিউটর (আইসিসি) যখন ইসরায়েল এবং হামাস নেতাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার আবেদন করেছিলেন, তখন তিনি একটি গোপন সতর্কতাও জারি করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি জোর দিচ্ছি যে, এই আদালতের কর্মকর্তাদের প্রতিবন্ধকতা, ভয় দেখানো বা অন্যায়ভাবে প্রভাবিত করার সব প্রচেষ্টা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।
প্রধান প্রসিকিউটর করিম খান আইসিসির কাজে হস্তক্ষেপের প্রচেষ্টার সুনির্দিষ্ট বিবরণ প্রদান করেননি। তবে তিনি আদালতের মৌলিক চুক্তির একটি ধারা উল্লেখ করেছিলেন। তাতে বলা হয়েছে, আদালতের কর্মকাণ্ডে এই ধরনের হস্তক্ষেপকে ফৌজদারি অপরাধ বলা হয়েছে। যদি কারো এ ধরনের আচরণ অব্যাহত থাকে তাহলে ‘আমার অফিস পদক্ষেপ নিতে দ্বিধা করবে না’-বলেছিলেন করিম খান।
কারা বিচার প্রশাসনে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করেছিল বা তারা ঠিক কীভাবে তা করেছিল তা প্রসিকিউটর বলেননি।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান এবং ইসরায়েলভিত্তিক ম্যাগাজিন প্লাস ৯৭২ ও লোকাল কল একটি তদন্তে জানতে পেরেছে, ইসরায়েল আদালতের বিরুদ্ধে প্রায় এক দশক ধরে গোপন ‘যুদ্ধ’ চালিয়েছে। আদালতের তদন্তকে লাইনচ্যুত করার প্রয়াসে দেশটি তার গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে নজরদারি, হ্যাক, চাপ এবং আইসিসির সিনিয়র কর্মীদের হুমকি দেওয়ার কাজে ব্যবহার করেছিল।
ইসরায়েলি গোয়েন্দারা করিম খান এবং তার পূর্বসূরি ফাতু বেনসুদার ফোন কল, বার্তা, ইমেল ও নথি হস্তগতসহ অসংখ্য আইসিসি কর্মকর্তার যোগাযোগের ওপর পূর্ণ নজরদারি চালিয়েছে।
ঘটনার সঙ্গে পরিচিত একটি সূত্র জানিয়েছে, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ইসরায়েলের এই নজরদারি আরো জোরেশোরে চলেছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু তাই আইসিসির প্রসিকিউটরের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আগাম তথ্য পেয়েছিলেন। ইসরায়েলিদের বিরুদ্ধে করিম খান যখন গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতে চাচ্ছিলেন তখন ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে’ তার ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয় নেতানিয়াহু সরকার।
২০১৫ সালে ফিলিস্তিনকে যখন আইসিসির সদস্য করা হয়, তখন থেকেই আদালতের বিরুদ্ধে অলিখিত যুদ্ধ ঘোষণা করে ইসরায়েল। ফিলিস্তিনে যোগদানের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আদালতের প্রসিকিউটর ফাতু বেনসুদা আদালতের কার্যক্রমে ‘ফিলিস্তিনের পরিস্থিতি’ নামে একটি প্রাথমিক তদন্ত অন্তর্ভূক্ত করেন। এর পরের মাসেই দু’জন ব্যক্তি বেনসাদুার বাড়িতে উপস্থিত হন। তারা ওই বাড়িতে একটি খাম রেখে বেমালুম গায়েব হয়ে যান। পরে সেই খাম খুলে কয়েক হাজার ডলার এবং একটি ছোট্ট চিঠি পাওয়া যায়। চিঠিতে একটি ইসরায়েলি ফোন নাম্বার ছিল। বিষয়টি আইসিসির কর্মকর্তাদের জানান বেনসুদা। বিষয়টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, এর মাধ্যমে ইসরায়েল বেনসুদাকে বার্তা দিতে চেয়েছিল যে, তারা জানে বেনসুদা কোথায় বাস করেন।
আইসিসির বিরুদ্ধে গোয়েন্দা অভিযানে ঘনিষ্ঠ অনেক বেশি আগ্রাহী ছিলেন ইসরায়েলে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। তার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের তত্ত্বাবধানে দেশীয় গুপ্তচর সংস্থা শিন বেট, সামরিক গোয়েন্দা অধিদপ্তর আমান এবং সাইবারইন্টেলিজেন্স ডিভিশন ইউনিট ৮২০০ জড়িত ছিল। প্রাপ্ত গোয়েন্দা তথ্য সরকারের বিচার, পররাষ্ট্র এবং কৌশলগত বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছে সরবরাহ করা হতো।
ইসরায়েলের গোয়েন্দা কার্যক্রমের সাথে পরিচিত পাঁচটি সূত্র জানিয়েছে, ফিলিস্তিনিদের সাথে বেনসুদা এবং তার কর্মীদের ফোন কলগুলো রেকর্ড করতো ইসরায়েলি গোয়েন্দারা। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের কর্মীদের সঙ্গে গোপনে বৈঠকও করেছিল ইসরায়েলের গোয়েন্দা প্রতিনিধি দল। এমনকি ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সাবেক প্রধান কোহেন ব্যক্তিগতভাবে হুমকি দিয়েছিলেন বেনসুদাকে। সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলে আইসিসির বিরুদ্ধে কিছু করতে না পারলেও ট্রাম্পের আমলে আদালতকে একহাত দেখে নেয় ইসরায়েল। কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে বেনসুদার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে সক্ষম হয় নেতানিয়াহু সরকার।