গুলশান-বারিধারায় বিভিন্ন বিদেশি দূতাবাস ফুটপাতের জায়গা দখল করে নিরাপত্তা চৌকি গড়ে তুলেছিল। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে প্রভাবশালী দেশগুলোর দূতাবাসের তথাকথিত এই নিরাপত্তা স্থাপনা অপসারণ করা সম্ভব- তা কল্পনাও করতে পারেননি কেউ। তবে এখন এসব এলাকার ফুটপাত দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করতে পারছেন নগরবাসী। এই কাজটি করেছিলেন প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক।
নিরাপত্তার নামে কংক্রিটের ব্লক বসানোয় ফুটপাতে পথচারী চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেসব নিরাপত্তা ব্লক অপসারণ করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। এমন উদাহরণ আরও আছে। যেমন, ২০১৫ সালের ২৯ নভেম্বর তেজগাঁওয়ে অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদ করতে গিয়ে অবরুদ্ধ হন আনিসুল হক। শেষ পর্যন্ত তেজগাঁও সাতরাস্তা থেকে তেজগাঁও রেলক্রসিং পর্যন্ত সড়কের ওপর অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদ করতে সক্ষম হন। পরে সড়কটির আধুনিকায়ন করে দৃষ্টিনন্দন সড়ক বিভাজক নির্মাণ করা হয়।
আনিসুল হকের সেই অর্জন প্রায় ম্লান হতে বসেছে। মাঝে মাঝেই সেখানে আবারও রাস্তা দখল করে ট্রাক-কাভার্ডভ্যান পার্কিং করে থাকতে দেখা যায়। ঠিক এ রকম আশা-নিরাশার দোলাচলে আজ পূর্ণ হতে চলেছে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির দ্বারা পরিচালিত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) তিনটি বছর। ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল ডিএনসিসির মেয়র নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে মেয়র নির্বাচিত হন আনিসুল হক। পরে ৬ মে এই দিনে মেয়র হিসেবে শপথ নেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও জনপ্রিয় মিডিয়া ব্যক্তিত্ব আনিসুল হক।
গত বছরের ২৯ জুলাই সপরিবারে লন্ডনে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তার মস্তিস্কের রক্তনালিতে প্রদাহজনিত সেরিব্রাল ভাস্কুলাইটিস রোগ ধরা পড়ে। গত ৩০ নভেম্বর লন্ডনের একটি হাসপাতালে তিনি মারা যান।
আনিসুল হকের অনুপস্থিতিতে গত ৪ সেপ্টেম্বর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ২১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ওসমান গণিকে ডিএনসিসির প্যানেল মেয়র হিসেবে দায়িত্ব দিয়ে গেজেট প্রকাশ করে। ১৪ নভেম্বর তিনি প্যানেল মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন।
আনিসুল হকের আড়াই বছর ও মো. ওসমান গণির ছয় মাসের দায়িত্ব পালনের সময়কাল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আনিসুল হকের নেওয়া উদ্যোগগুলোই বর্তমানে বাস্তবায়নের কাজ চলছে। কিছু উদ্যোগ বাস্তবায়নে চলছে ধীরগতি। দাপ্তরিক কাজেও সৃষ্টি হয়েছে গতিহীনতা। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমেও এখন ঢিলেমি ভাব। ঠিকাদাররা যথাসময়ে বিল পাচ্ছেন না। ঠিকাদারি কাজের স্বচ্ছতা ও মান নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। নাগরিক সেবাদান কার্যক্রমও গতি হারিয়েছে। টেবিলে টেবিলে জমছে ফাইলের স্তূপ। গুরুত্বপূর্ণ কোনো সিদ্ধান্ত কেউ দিতে পারছেন না। বিভিন্ন কাজেও বিভিন্ন দপ্তর থেকে বাধা আসছে। অসাধু কর্মকর্তারা এতদিন কিছুটা দমে থাকলেও আবার তারা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করেছেন। আনিসুল হকের মৃত্যুতে তারা মনে মনে তুষ্টি লাভ করছেন বলে হাবভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে।
আমিনবাজার-শ্যামলী সড়ককে পার্কিং ফ্রি ঘোষণা করা হলেও সেখানে হরহামেশাই পার্কিং করতে দেখা যাচ্ছে। আবদুল্লাহপুর থেকে তেজগাঁও সাতরাস্তা পর্যন্ত ৮টি ইউটার্নের নির্মাণকাজ সড়ক ও জনপথ বিভাগের বাধায় বন্ধ আছে। ৪ হাজার বাস নামানোর বিষয়টির দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। কয়েকটি কোম্পানির আওতায় এনে পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা আনার উদ্যোগও বাস্তবায়ন হচ্ছে না। কারওয়ান বাজারকে মহাখালীতে স্থানান্তরের কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই। মহাখালীতে বিশাল বহুতল ডিএনসিসি মার্কেটটি বছরের পর বছর ফাঁকা পড়ে আছে। বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউয়ে নির্মিত ফুডকোর্টের অবস্থাও একই রকম। ফুট ওভারব্রিজগুলোতে যে সবুজায়ন করা হয়েছিল, সেই গাছগুলোর প্রায় সবই মরে গেছে।
ঠিকাদাররা যাতে ঠিকমতো বিল পান, এ জন্য প্রত্যেকটি বিলের চেক কর্মচারীদের দিয়ে ঠিকাদারদের অফিসে পাঠিয়ে দেওয়ার রীতি বন্ধ হয়ে গেছে। বিলবোর্ড-ব্যানার-ফেস্টুনের দৌরাত্ম্য বন্ধ হলেও বর্তমানে মাঝে মাঝেই বিভিন্ন স্থানে ব্যানার-ফেস্টুন সাঁটাতে দেখা যাচ্ছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার চেয়ে বিউটিফিকেশনের দিকে কর্তৃপক্ষের এখন নজর বেশি। ফলে নগরীর অনেক স্থানেই এখন বর্জ্যের স্তূপ চোখে পড়ছে।
জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য আনিসুল হক যে দৌড়ঝাঁপ করেছিলেন, সেটা নিয়ে এখন হাল ছেড়ে দিয়ে বসে আছে ডিএনসিসি। জলাবদ্ধতা নিরসনে আনিসুল হক তিনটি পৃথক জলাধার তৈরির যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সেগুলোর কাজও এগিয়ে নেওয়ার কোনো উদ্যোগ নেই। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যেও দেখা দিয়েছে ঢিলেমি ভাব। বিভিন্ন আঞ্চলিক কার্যালয়েও বাড়ছে সেবাগ্রহীতাদের ভোগান্তি। দাপ্তরিক কাজেও দেখা দিয়েছে গতিহীনতা। বিভিন্ন স্থানে ফুটপাতে হকারদের দৌরাত্ম্য আরও বেড়েছে। ফলে পথ চলতে নগরবাসীকে ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে।
মিরপুর, মোহাম্মদপুরসহ কয়েকটি এলাকায় প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে আধুনিকায়ন প্রকল্পের কাজ চলছে অনেকটা ধীরগতিতে। মিরপুরের অনেক এলাকা খুঁড়ে রাখা হচ্ছে দীর্ঘদিন। ওইসব এলাকায় নগরবাসীর ভোগান্তির অন্ত নেই। বনানী করবস্থানের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ এখনও শুরু হয়নি। বিভিন্ন উন্নয়নকাজের প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষেত্রেও তেমন তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। অনেক এলাকার রাস্তাঘাটও বর্তমানে ভাঙাচোরা। ঠিকাদারি কাজে আবারও প্রকৌশলীদের অসাধুতা ও মানহীনতার প্রশ্নও আসছে। সম্প্রতি মশার যন্ত্রণায়ও ভুগতে হয়েছে নগরবাসীকে।
প্যানেল মেয়র মো. ওসমান গণি বলেন, মশার যন্ত্রণার নেপথ্যে ক্যান্টনমেন্ট, বিমানবন্দর, মহাখালী ডিওএইচএস ও বারিধারা ডিওএইচএস। এসব এলাকার মশা মারার দায়িত্ব ডিএনসিসির নয়। এ ছাড়া বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা আছে। আফতাবনগর আছে। সেটাও ডিএনসিসির অধীনে নয়। ওইসব এলাকার মশাও ডিএনসিসি এলাকায় চলে আসে। ফলে মশার নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে যায়। তার পরও তারা চেষ্টা করে মশা নিয়ন্ত্রণে এনেছেন।
আনিসুল হকের উদ্যোগগুলো ধরে রাখা প্রসঙ্গে ওসমান গণি বলেন, একটি কাজ করে সেটা রক্ষা করা আরও কঠিন। তেজগাঁও সাতরাস্তা এলাকার রাস্তাকে দখলমুক্ত রাখতে তিনি নিয়মতি পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর কাজগুলো বুঝতে তার দুই মাস সময় লেগে গেছে। এ সময়ে ডিএনসিসির কাউন্সিলর ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাকে সহযোগিতা করেছেন। এখন আর কোনো সমস্যা নেই। প্রত্যেকটি কাজেই গতি ফিরে এসেছে। জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য কমিটি হয়েছে। কমিটিকে ডিএনসিসি সহযোগিতা করছে। এই কমিটিও রাজধানীর জলাবদ্ধতার সমস্যা গুরুত্বসহকারে দেখবে।
মহাখালী ডিএনসিসি মার্কেট ও বনানীর ফুডকোর্ট সম্পর্কে বলেন, কিছু কাজ অতীতে ইমোশনালি করা হয়েছে, বাস্তবতাটা পর্যালোচনা না করে। মহাখালীতে তো যমুনা ফিউচার পার্কের মতো মার্কেট চলবে না। ফুডকোর্টের স্থলে বহুতল মার্কেট করে ডিএনসিসি রাজস্ব আদায় বাড়াতে পারত। তবে এগুলোর দামও বেশি ধরা হয়েছে। বাস্তবসম্মত দাম ধরলে মহাখালী ডিএনসিসি মার্কেট এতদিন বরাদ্দ দেওয়া হয়ে যেত। এখন সেটাই পর্যালোচনা করা হচ্ছে। শেরেবাংলা নগর থেকে পল্লবী পর্যন্ত রাস্তার বেহাল দশা সম্পর্কে বলেন, সেখানে মেট্রোরেল হচ্ছে। মেট্রোরেল প্রকল্প শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওই রাস্তা দেখভালের দায়িত্ব মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের।
তিনি বলেন, আনিসুল হক অনেক ভালো উদ্যোগ নিয়েছিলেন। সেগুলো বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তবে একটা চ্যালেঞ্জ সামনে রয়েছে ডিএনসিসিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া নতুন ১৮টি ওয়ার্ড নিয়ে। সেখানে পরিকল্পনা রয়েছে প্রত্যেকটি ওয়ার্ড আধুনিকভাবে সজ্জিত করার। সেখানে যাতে প্রত্যেকটি ওয়ার্ডে প্রয়োজনীয় সংখ্যক খেলার মাঠ, ব্যায়ামাগার, মসজিদ, পার্ক, বর্জ্য রাখার স্থান (এসটিএস) রাখা যায় সেভাবে পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
কাজের মান ও ঠিকাদারি কাজের বরাদ্দে ঘুষ লেনদেনের প্রসঙ্গে বলেন, যখন কোনো ঠিকাদারের বিপক্ষে কিছু যায়, তখনই এ ধরনের অভিযোগ করে। তবে এসবের পুরোটাই যে মিথ্যা তাও বলা যাবে না। পুরোটাই সত্য তাও বলা যাবে না। আমলাদের প্রভাব সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য বলে মন্তব্য করেন তিনি।
© স্বত্ব আর্থটাইমস্ ২৪.কম
প্রকাশক ও সম্পাদক: মোঃ জাকারিয়া আলম (দিপু)
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ:বরিশাল-৮২০০।
আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:::
নিউজ মেইল:::
earthtimes24@gmail.com(নিউজ)
news@earthtimes24.com(নিউজ)
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
২০১৭ সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত earthtimes24.com