পাবনার সুজানগর উপজেলার চিনাখড়া উচ্চ বিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী রিয়া খাতুন (১২)। ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছাত্রী হওয়ায় ক্লাসে সব সময় প্রথম স্থানটি থাকে তার অধিকারে।
কিন্তু হঠাৎ করেই তার জীবনে নেমে আসে ঘোর অমানিশা। এই বয়সে বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে। ৪২ বছর বয়সী বিবাহিত এক ব্যক্তির সঙ্গে বিয়ে মেনে নিতে না পেরে সিদ্ধান্ত নেয় আত্মহত্যার। তাকে সে পথ থেকে ফেরায় তার সহপাঠী বান্ধবীরা।
এরপর স্কুলশিক্ষকের মাধ্যমে আইনি সহায়তা চাওয়া হয় ইউএনওর কাছে। সেখান থেকে তার স্থান হয় নতুন অভিভাবক স্থানীয় পৌর মেয়রের কাছে।
জানা যায়, মাত্র চার বছর বয়সে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান রিয়া খাতুনের বাবা রেজাউল করিম। পরে তার নানার বাড়ি পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বেথুরিয়া গ্রামে আশ্রয় নেন রিয়া ও তার মা মরিয়ম খাতুন। কিছুদিন পর তার মায়ের বিয়ে হয় একই উপজেলার মাবুদ আলী নামক এক ব্যক্তির সঙ্গে। দরিদ্র নানার বাড়িতে থেকেই অনেক কষ্টে লেখাপড়া চালিয়ে যায় রিয়া। এর মধ্যে হঠাৎ করে সম্প্রতি রিয়ার সৎ বাবা ও মা নানার বাড়ি গিয়ে বেড়ানোর কথা বলে রিয়াকে নিয়ে যান তারা। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই রিয়াকে জোর করে সুজানগর উপজেলার রানীনগর ইউনিয়নের শারীরভিটা গ্রামের ৪২ বছর বয়সী নাছির হোসেন নামের এক বিবাহিত ব্যক্তির সঙ্গে দেড় লাখ টাকা দেনমহরে বিয়ে দেন সৎ বাবা ও মা। মতের বিরুদ্ধে জোর করে বিয়ে দিলেও রিয়া কোনোমতেই তার স্বামীর বাড়িতে যেতে রাজি না হওয়ায় তাকে আর নিতে পারে না শ্বশুর বাড়ির লোকজন।
আলাপকালে রিয়া জানায়, নির্যাতন সইতে না পেরে আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নিই। তবে কয়েকদিন স্কুলে না যাওয়ায় কয়েকজন সহপাঠী খবর নিতে বৃহস্পতিবার আমার কাছে আসে। তখন বান্ধবীদের কাছে সব ঘটনা খুলে বলি। তখন বান্ধবীরা নানিকে স্যাররা রিয়াকে দেখা করতে বলেছেন জানিয়ে আমাকে বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শরিফুল ইসলামের কাছে নিয়ে যায়। পরে সব কথা স্যারকে জানাই।
সহকারী শিক্ষক শরিফুল ইসলাম জানান, বিষয়টি শোনার পর প্রথমে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম শাহজাহানকে জানাই। পরে সুজানগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার সুজিত দেবনাথ রিয়ার কাছে বিস্তারিত ঘটনা শোনেন।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুজিত দেবনাথ জানান, বিষয়টি উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল কাদের রোকন, পৌর মেয়র আবদুল ওহাব, পাবনা সহকারী পুলিশ সুপার ফরহাদ হোসেন, ওসি শরিফুল আলম, উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা জান্নাতুল ফেরদৌস লাবনীকে অবগত করে তাদের নিয়ে বসে আলোচনা করেন। সেইসঙ্গে মেয়েটির সৎ বাবা ও তার মাকে স্থানীয় ইউপি সদস্যের মাধ্যমে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় অফিসে ডেকে আনা হয়। তখন রিয়ার সৎ বাবা ও মার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বললে তারা তাদের ভুল স্বীকার করে ক্ষমাপ্রার্থনা করেন।
তারা বলেন, উপস্থিত যদি কেউ রিয়াকে নিয়ে পড়াশোনা করিয়ে মানুষের মতো মানুষ করাতে চায় এবং রিয়াও যদি সেখানে থাকতে চায় সে ক্ষেত্রে তাদের কোনো আপত্তি থাকবে না। এ সময় উপস্থিত প্রশাসনের কর্মকর্তাবৃন্দ ও জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে পৌর মেয়র আবদুল ওহাব রিয়ার অভিভাবকের দায়িত্ব নেন।
পৌর মেয়র আবদুল ওহাব বলেন, রিয়া মেধাবী ছাত্রী। তার সৎ বাবা-মা টাকার লোভে মেয়েটির জীবন নষ্ট করতে যাচ্ছিল, যা খুবই বেদনাদায়ক। তাই মানুষ হিসেবে আরেকজন অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর যে সামাজিক দায়িত্ব তার অংশ হিসেবে আমি রিয়ার অভিভাবকের দায়িত্ব নিয়েছি।
এর প্রতিক্রিয়ায় রিয়া জানায়, আমি লেখাপড়া করে মানুষ হতে চাই। নতুন জীবনে নতুন করে পথ চলতে চাই।