আকাশি-সাদা জার্সি মানেই আর্জেন্টিনা। ঐতিহ্যবাহী এই জার্সির মাহাত্ম্য আর্জেন্টিনার খেলোয়াড় থেকে সমর্থক—সবার কাছেই অন্য রকম। কিন্তু আর্জেন্টিনার জার্সির গল্পটা কি জানেন?
‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ বিশ্বকাপের দামামা বেজে উঠলেই সমর্থকদের মধ্যে জেগে ওঠে উন্মাদনা। কে কোন দলের সমর্থক, তা জার্সি কিনে ও পতাকা উড়িয়ে জাহির করার মধ্যেই তো আনন্দ। প্রতিটি দলের সমর্থকদেরই কৌতূহলের কেন্দ্রতে থাকে বিশ্বকাপ উপলক্ষে বাজারে আসা জার্সি। নতুন এক জার্সি, যা গায়ে জড়িয়ে আরেকটি বিশ্বকাপের পথে যাত্রা সূচনা করবে পছন্দের দল। বেশির ভাগ দলের জার্সিতে নতুনত্ব দেখা গেলেও আর্জেন্টাইন সমর্থকদের জানাই থাকে, তাদের জার্সিটা হবে পুরোনো ঘরানার আকাশি-সাদা জার্সিরই নতুন এক রূপ। আর্জেন্টিনার অতিপরিচিত এই জার্সির পেছনের গল্পটা শোনা যাক।
আকাশের সঙ্গে তুলনা করা যায় আর্জেন্টিনার জার্সিকে। আকাশের ‘আকাশি’ আর মেঘের ভেলার ‘সাদা’ রং। এই দুইয়ে মিলেই ম্যারাডোনা-মেসির দেশের ট্রেডমার্ক জার্সি। আর্জেন্টিনার জার্সি প্রস্তুত করে থাকে জার্মানির অ্যাডিডাস। মাঝের তিন বছর (১৯৯৯-২০০১) বাদ দিয়ে বিশ্ব বিখ্যাত এই ব্র্যান্ডের জার্সি গায়ে দিয়ে সেই ১৯৯০ বিশ্বকাপ থেকে এখন পর্যন্ত খেলে যাচ্ছে আর্জেন্টিনা। এবারের বিশ্বকাপের জার্সি বানানো হয়েছে অনেকটা ১৯৯৩ সালের কোপা আমেরিকা ফুটবলের জার্সির ঢঙে। আকাশি-সাদা জার্সির ডোরাকাটা রয়েছে প্রতিবারের মতোই। তবে কাঁধের ওপর রয়েছে অ্যাডিডাসের নিজস্ব ঢংয়ের তিনটি কালো দাগ।
১৯৩০ বিশ্বকাপ থেকেই আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়দের গায়ে শোভা পেত এই আকাশি-সাদা জার্সি। সেবার রানার্সআপ হওয়া জার্সির সঙ্গে শোভা পেত ঘন নীল রঙের শর্টস। ’৭৮ বিশ্বকাপের পর থেকে আর্জেন্টাইন খেলোয়াড়েরা গাঢ় নীল শর্টস বাদ দিয়ে কালো শর্টস পরে খেলা শুরু করেন।
আর্জেন্টিনা আর বিশ্বকাপ, দুটো কথা এলে যে একটি গোলের নাম আসবেই, সেটা হলো ম্যারাডোনার ‘হ্যান্ড অব গড’। কিন্তু সেই ১৯৮৬ মেক্সিকো বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালের জার্সির গল্পটাও কিন্তু কম রোমাঞ্চকর নয়। সেবার মেক্সিকোতে আর্জেন্টাইনদের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল তাপমাত্রা আর আর্দ্রতা। আকাশি-সাদা ডোরাকাটা মূল জার্সিতে খুব একটা সমস্যা নেই। কিন্তু ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তো আর সেই জার্সিতে নামা যাবে না, তাই পরতে হবে গাঢ় নীল রঙের দ্বিতীয় জার্সি। কিন্তু তা নিয়েই বিপত্তি।
অতিরিক্ত গরমের মধ্যে সে জার্সি গায়ে চাপানোই দায়। পাতলা কাপড়ের নতুন জার্সি বানানোরও সময় নেই। কোচ কার্লোস বিলার্দো সহকারী রুবেন মোশেল্লাকে পাঠালেন মেক্সিকো সিটির দোকান ঘুরে যদি কোনো নীল রঙের একটু আরামদায়ক কাপড়ের জার্সি পাওয়া যায়। মোশেল্লা হাজির হলেন অপেক্ষাকৃত দুটি পাতলা জার্সি নিয়ে। সেখান থেকে অধিনায়ক ডিয়েগো ম্যারাডোনা একটি হাতে নিয়ে বললেন, ‘এটা গায়ে জড়িয়েই আমরা ইংল্যান্ডকে হারাব।’ সেই দোকান থেকেই আরও ৩৮টি ওই রকম জার্সি কিনে আনা হলো। তড়িঘড়ি করে প্রতিটিতে সেলাই করে লাগানো হলো আর্জেন্টাইন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের ব্যাজ। কয়েক ঘণ্টা পরে সেই জার্সি গায়েই মাঠে নামল আর্জেন্টিনা দল। আর সেদিনের সেই কোয়ার্টার ফাইনালে কী হয়েছিল তা তো আর বলে দেওয়ার প্রয়োজন নেই! ম্যারাডোনার হ্যান্ড অব গড আর গোল অব দ্য সেঞ্চুরি—দুটো গোলেই ইতিহাস হয়ে আছে মেক্সিকোর গলি-ঘুপচি ঘুরে বের করে আনা সেই গাঢ় নীল রঙের পাতলা জার্সি।
আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে দিয়ে গত ২৮ বছরে অনেক রথী-মহারথী খেলে গেছেন। যাঁদের নামের সঙ্গে বিশ্বকাপ নেই ভাবতেও অবাক লাগে। বাতিস্তুতা, রিকুইলমে, কাম্বিয়াসো, তেভেজের মতো খেলোয়াড়দের বিদায় নিতে হয়েছে বিশ্বকাপের কোনো ট্রফি ছাড়াই। বিধাতা চোখ তুলে না তাকালে মেসির মতো বিশ্বসেরা ফুটবলারেরও তো সে একই ভয়। দেখা যাক ১৯৯৩ সালে কোপা আমেরিকায় যে ধরনের জার্সি গায়ে জড়িয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল আর্জেন্টিনা, রাশিয়া বিশ্বকাপে সে একই ঘরানার জার্সিটা কোনো সৌভাগ্য বয়ে আনতে পারে কি না?