বয়স মাত্র ২৭। তারুণ্যের আবেগে মাতিয়ে রাখতেন চারপাশ। প্রিয় ক্যামেরা নিয়ে সারাদিন ছুটে বেড়াতেন পথে-প্রান্তরে। সমাজের অসহায়দের ছবি তুলে ফেসবুকে প্রচার করে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন। জড়িত ছিলেন গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গেও। মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন প্রতিনিয়ত। কিন্তু হঠাৎ আত্মহত্যায় সবাইকে অবাক করে দিয়েছেন সাতক্ষীরা-১ (তালা-কলারোয়া) আসনের জাসদের এমপি অ্যাডভোকেট মুস্তফা লুৎফুল্লাহর ছেলে অনীক আজিজ।
তার এ চলে যাওয়া কারো কাছে সহজবোধ্য নয়। তবে রাজধানীতে এমপিদের বাসস্থান ন্যাম ফ্ল্যাটের কর্মকারীরা বলাবলি করছেন প্রেমই কাল হলো তার।
প্রসঙ্গত, এমপিদের বাসস্থান ঢাকার ৫নং ন্যাম ভবনের ৫০৪ নম্বর ফ্ল্যাটে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি। শনিবার রাতের কোনো এক সময় এ ঘটনা ঘটে। অনীক খুলনার সিটি পলিটেকনিক থেকে ইলেকট্রিক্যালে ডিপ্লোমা করেছেন। অ্যাডভোকেট মুস্তফা লুৎফুল্লাহ ওয়ার্কার্স পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য। এবারই প্রথম তিনি এমপি হন।
মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। এ সময় হাসপাতালের মর্গের সমানে কথা হয় দৈনিক দক্ষিণের মফশালের নির্বাহী সম্পাদক ও জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশনের সিনিয়র সভাপতি মিনাজুর রহমানের সঙ্গে। তিনি এমপি মুস্তফা লুৎফুল্লাহর বন্ধু।
তিনি বলেন, এমপি মুস্তফা ভাই তাদের বাচ্চাদের নিয়ে সবার বাসায় যেতেন। আমি তাকে শিশুকাল থেকে চিনি। অনীকের ভেতরে কোনো ভাব ছিল না। নিরীহ একটি ছেলে। খুব সাদামাঠা জীবন-যাপন করত। ওর ভেতরে কোনো অহমিকা বোধ ছিল না। কাউকে কোনো দিন কষ্ট দিয়ে কথা বলেনি। কখনও কারো সঙ্গে তর্ক করেনি। রাগ দেখায়নি।
তিনি আরও বলেন, অনীকের শখ ছিল ছবি তোলা। নিপীড়িন মানুষের ছবি তুলে ফেসবুকে আপ করত। কোনো নিপীড়ন বা অনিয়ম দেখলেই ছবি তুলে ফেসবুকে দিত। সে ছাত্রমৈত্রী করত। এমপির ছেলে হিসেবে কে কখনও স্পেস দখল করেনি। এমনকি এমপির গাড়ি ব্যবহার করে দশ হাত দূরেও যায়নি। গণজাগরণ মঞ্চে এক মাসেরও বেশি সময় ও মুক্তিযুদ্ধের ছবি প্রদর্শন করেছিল। প্রতিদিন রাত ৮টা পর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে উদ্বুদ্ধ করার জন্য ছবিগুলো দেখাতো সে। পজেটিভ বাংলাদেশ গড়ার জন্য সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে অনীক।
অনীকের ছোটবোন আদৃতা সৃষ্টি বলেন, বাবা-মার সঙ্গে খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল ভাইয়ের। ছেলে আর বাবা এক জায়াগায় বসে থাকলেও কেউ কখনও বুঝতে পারত তারা বাবা-ছেলে। বাবা কখন বাবার জায়গা থেকে কথা বলেনি। বন্ধুর মতো ইয়ার্কি ফাজলামি করেছে। আত্মহত্যার আগেও আমরা রাত ১১টা পর্যন্ত গল্প করেছি। এরপর কী হয়েছে আমি কিছুই বলতে পারব না।
অনিকের এক আত্মীয় জানান, পড়ালেখার চেয়ে মানুষের কল্যাণে সবসময় নিবেদিত ছিল অনীক।
অনীকের ফেসবুক ঘেটে পারিবারিক কয়েকটি ছবিতে বাবা-মা আর দুই ভাইবোনকে হাস্যেজ্জ্বল দেখা যায়। এছাড়াও প্রকৃতির সুন্দর দৃশ্যও ধারণ করে ফেসবুকে দিত সে। ছবি তোলার সখ থেকেই পাঠশালায় ফটোগ্রাফির কোর্স করেছিলেন তিনি।
প্রেমের কারণে আত্মহত্যা?
সকালে ন্যাম ফ্ল্যাট সরেজমিনে দেখা যায়, এমপির ফ্ল্যাটটি তালাবদ্ধ। মরদেহ সুরতহালের জন্য সোহরাওয়ার্দী হাসপাতলে নেয়া হয়েছে। সেখানেই গেছেন সবাই। তবে ফ্ল্যাটের নিচে দায়িত্বরত কর্মচারীরা বলাবলি করছিলেন, একটি মেয়ে প্রায়েই অনীকের কাছে আসত। মেয়েটির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। এ প্রেমই নাকি আত্মহত্যার কারণ। তবে এ বিষয়ে তারা আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য দিতে চায়নি।
নিজ এলাকার এক অধিবাসী নারী এসেছিলেন এমপির সঙ্গে দেখা করতে। তিনি এসে শুনেন এমপির ছেলে আত্মহত্যা করেছেন। ওই নারীও আফসোস করে বলেন, তাহলে সেই প্রেমই কি কাল হলো?
তবে এ বিষয়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেও কেউ কোনো মন্তব্য করেননি।
দুপুর ১টায় রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে মরদেহের ময়নাতদন্ত হয়। এ সময় হাসপাতালে এমপি, মরহুমের বোন আদৃতা সৃষ্টি ছাড়াও আত্মীয়-স্বজন ও এলাকার লোকজন উপস্থিত ছিলেন। এরপর হেলিকপ্টারে তাকে সাতক্ষীরায় নেয়া হয়।
মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে ফরেনসিক মেডিকেলের প্রধান চিকিৎসক অধ্যাপক আ ম সেলিম রেজা সাংবাদিকদের বলেন, গলায় ইন্টারনেটের তার পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছেন তিনি। শরীরের আর কোনো জায়গায় আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
জানা গেছে, বাবা এমপি মুস্তফা লুৎফুল্লাহর সকালে সাতক্ষীরা থেকে ঢাকায় আসনে। এরপর ছেলের রুমের দরজায় ধাক্কা দিয়ে না খুললে এক পর্যায়ে দরজা ভেঙে মরদেহ দেখতে পান।