দ্বিতীয় মেয়াদের পঞ্চম বর্ষে আজ পদার্পণ করল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার। এই দীর্ঘ সময়ে সরকার অর্থনৈতিক অগ্রগতির ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে। আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রেও সাফল্যজনক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পেরেছে। তবে রাজনৈতিক প্রশ্নে ব্যর্থতার পাশাপাশি সামনে চ্যালেঞ্জও রয়েছে। এমনটাই মনে করছেন দেশের বিশিষ্টজনেরা।
তারা বলছেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে রাজনৈতিক উন্নয়নের অসামঞ্জস্যতা রয়েছে। রাজনৈতিক উন্নয়ন না হওয়ায় সরকারের অর্থনৈতিক সাফল্যগুলো অনেকটাই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। আগামীতে বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধি, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন, সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বলেও মত বিশিষ্টজনদের।
এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, অর্থনৈতিক দিক থেকে সফলতা আছে, গণতন্ত্রের দিক থেকে আমরা পেছনে পড়েছি। দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে, গুম-খুন চারদিকে হচ্ছে। আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। আমাদের দেশে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটেছে। এটা তো সুখকর পরিস্থিতি নয়।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষা ড. গোবিন্দ চক্রবর্তী বলেন, অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সরকার সফল। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতা সরকার ধরে রাখছে। স্থানীয় জনগণের প্রচেষ্টায় অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে, যেখানে বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ তুলনামূলক কম। আমাদের প্রবৃদ্ধি রেমিট্যান্স ও পোশাক শিল্পের উপর নির্ভরশীল। এখানে নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। সাম্প্রদায়িক ও জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় সরকারের সফলতা রয়েছে। রোহিঙ্গাদের সাময়িকভাবে আশ্রয় দিয়ে মানবিক রাষ্ট্রের পরিচয় দিয়েছে সরকার। এ বছর সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে এই রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন। রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে সরকারকে সচেষ্ট হতে হবে, দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। তিনি বলেন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রশ্নে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর বিভিন্ন জায়গায় হামলা মোকাবেলায় সরকার ব্যর্থ। রাজনৈতিক সম্প্রীতি রক্ষায় সরকার ব্যর্থ। বিরোধী দলকে সেভাবে স্পেস দেয়নি। আগামীতে সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচন। বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মিজানুর রহমান শেলী বলেন, আমাদের এখানে বলার বিশেষ কিছু নেই। এ কথা সর্বজনবিদিত যে, বিভিন্ন দিক যেমন অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও বেশ কিছু সাফল্যজনক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক ব্যর্থতা অত্যন্ত মর্মান্তিক অবস্থার মধ্যে রয়েছে। রাজনৈতিক উন্নয়নের একটা স্লোগান আছে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন যেমন হয়, তেমনি রাজনীতিরও একটা উন্নয়ন আছে। রাজনৈতিক উন্নয়ন মানে বহুদলীয় গণতন্ত্র, দলের মধ্যে গণতন্ত্র চর্চা এবং দলের বাইরে বিশাল অঙ্গনে গণতন্ত্র চর্চা।
তিনি বলেন, বিশেষ করে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গগুলোর মাঝে ভারসাম্য রক্ষা হয়। আইনসভা ও প্রশাসনের মাঝে একটা ভারসাম্যের ব্যাপার আছে। আবার উচ্চ আদালত ও সংসদ, নির্বাহী বিভাগকে ভারসাম্যের মধ্যে রাখে। সেখানে একটা ভারসাম্যের অভাব হচ্ছে আমরা দেখতে পাচ্ছি। প্রশাসন অনেকটা রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় দলীয়করণ একটা বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছাতে প্রশাসন এখন আর নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারছে না। এর ফলে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে, সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারছে না।
শুধুমাত্র ক্ষমতাসীন দলই নয়, অন্যান্য দলের মাঝেও ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ দেখা যাচ্ছে। এমনভাবে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ হয়েছে যে, দলের দ্বিতীয় পর্যায়ের নেতৃত্ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। রাজনীতি আর রাজনীতিকদের হাতে নেই। ব্যবসা-বাণিজ্যে যারা সফল, তারা অর্থের দাপটে এগুলোকে কুক্ষিগত করছে। ফলে সমাজে অর্থ এবং বিত্তের প্রভাব অত্যন্ত প্রবল। যার ফলে মূল্যবোধের অবক্ষয় দেখা যাচ্ছে, তা আরও প্রবলভাবে অভিঘাত সৃষ্টি করে সমাজকে একটা করুণ অবস্থায় নিয়ে যাচ্ছে। যেখানে পারস্পারিক সমঝোতা, সম্মান, সহনশীলতা সবকিছুর অভাব দেখা যাচ্ছে। টাকার জন্য টাকা, টাকার মাধ্যমে ক্ষমতা, ক্ষমতার মাধ্যমে টাকা- এভাবে একটা রাজনীতির বিস্তৃতি ঘটছে।