অরক্ষিত রেললাইন, থামছে না মৃত্যুর মিছিল!

:
: ২ years ago

যোগাযোগ ব্যবস্থায় অপেক্ষাকৃত ‘নিরাপদ বাহন’ হিসেবে বিবেচনা করা হয় ট্রেনকে। নিরাপদ গণপরিবহন হিসেবে ট্রেন সারাবিশ্বে স্বীকৃত। কিন্তু দেশে রেললাইন ঘিরে প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে মৃত্যু। ট্রেনের ধাক্কায় বা ট্রেনে কাটা পড়ে প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। রেলক্রসিংয়ে (লেভেল ক্রসিং) ট্রেনের সঙ্গে অন্য যানবাহনের সংঘর্ষেও ঘটছে প্রাণহানি। মৃত্যুর পরিসংখ্যান হিসাব করলে প্রতিদিন গড়ে রেললাইন থেকে অন্তত দু’জনের মৃতদেহ পাওয়া যাচ্ছে। মাসে গড়ে প্রাণ যাচ্ছে ৬৪ জনের। গত বুধবার কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার বিজয়পুরে রেললাইন পার হওয়ার সময় ট্রেনে কাটা পড়ে তিন স্কুলছাত্রী। ঘটনাস্থলেই মর্মন্তুদ মৃত্যু হয় তাদের।

রেলওয়ে পুলিশের তথ্য বলছে, তিন বছরে শুধু রেললাইনে লাশ পাওয়া গেছে দুই হাজার ৩১১ জনের। এর মধ্যে পুরুষ এক হাজার ৭৬৩ জন। আর নারী ৫৪৮ জন। পরিসংখ্যানের উদ্বেগজনক চিত্র হলো, রেললাইনে ছাত্রছাত্রীর মৃত্যুর সংখ্যাও কম নয়। প্রতিবছর গড়ে ৬২ শিক্ষার্থীর মৃত্যু হচ্ছে রেললাইনে। গত দুই বছরে ছাত্রছাত্রী মারা গেছে ১২৪ জন। আর রেললাইনে মৃত্যুর একটি বড় অংশের কারণ চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। ‘দুর্ঘটনা’ নাকি ‘হত্যা’ করে লাশ রেললাইনে ফেলে রাখা হয়েছে- তা স্পষ্ট না হওয়ায় অপরাধীরাও পার পেয়ে যাচ্ছে। কিছু ঘটনায় হত্যার আলামত নষ্ট করতে রেললাইনে লাশ ফেলে যায় দুর্বৃত্তরা। ট্রেনের চাপায় লাশ ক্ষতবিক্ষত হওয়ার পাশাপাশি তদন্তও ধামাচাপা পড়ে যায়।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ড. এম শামসুল হক বলেন, রেল ঘিরে এত বিশাল বিনিয়োগের পাশাপাশি নিরাপত্তার দিকে নজর না দিলে রক্তক্ষরণ হবেই। পৃথিবীর কোনো আধুনিক ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় মাটিতে রেখে রেলের তিন বা চার লাইনের যোগাযোগ নেটওয়ার্ক করা হচ্ছে না। এটা আমাদের দেশে হচ্ছে। বৈজ্ঞানিক চিন্তার সঙ্গে যা সাংঘর্ষিক। তিনি বলেন, সড়ক, নৌ ও রেলপথে যাত্রীর নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় নিয়েই যুগ যুগ ধরে রেলপথকে সবচেয়ে নিরাপদ বলে বিবেচনা করা হয়। ব্রিটিশরা ৪৪৪ ধারায় দ্রুতগতির যান হিসেবে রেলের চালককে ‘দায়মুক্তি’ দিয়ে গেছে। এর অর্থ হলো, রেলের সঙ্গে সংঘর্ষ হলে চালক রেহাই পাবেন। আর রেললাইনের ১৫ ফুটের মধ্যে কোনো স্থাপনা বা বসতি থাকার কথা নয়; কিন্তু থাকছে। বাধ্য হয়েই মানুষকে ঝুঁকি নিয়ে অহরহ রেললাইন পার হতে হচ্ছে।

রেলওয়ে পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি দিদার আহমেদ বলেন, রেললাইনে কোনো লাশ পাওয়া গেলে সাধারণত ময়নাতদন্ত ও সুরতহাল ছাড়া স্বজনকে মরদেহ দেওয়া হয় না। কারণ সব মৃত্যুই যে দুর্ঘটনায়, এটা আমরা মনে করি না। দুস্কৃতকারীরা অনেক সময় হত্যার পর লাশ ফেলে যেতে পারে। সম্প্রতি কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও ফেনীতে কয়েকটি ঘটনা পাওয়া যায়। যেখানে দেখা যায়, হত্যার পর লাশ রেললাইনে ফেলে যায় খুনিরা। তাই যে কোনো মৃত্যুর পর দালিলিক সাক্ষ্য-প্রমাণ সংরক্ষণ করা হয়।

রেলওয়ে পুলিশের ২০১৯, ২০২০ ও ২০২১ সালের পরিসংখ্যান বিশ্নেষণ করে দেখা যায়, ২০১৯ সালে রেললাইনে মোট মৃত্যু হয় ৯৮০ জনের। তাদের মধ্যে পুরুষ ৭৩১ ও নারী ২৪৯ জন। ২০২০ সালে ৭১৩ ও ২০২১ সালে ৬১৮ জনের লাশ পাওয়া গেছে। রেললাইনে পাওয়া লাশের বয়স ও পেশার শ্রেণিবিন্যাসও পাওয়া গেছে। এতে উঠে আসে, ২০১৯ সালে নিহতদের ৭০ জনের বয়স ১৮ বছরের নিচে। ১৯ থেকে ৫০ বছর বয়সের ৬৫৮ জন। ৫০-এর বেশি বয়স ছিল ২৫২ জনের। পেশার বিশ্নেষণ করলে দেখা যায়, ২০১৯ সালে রেললাইনে ৭৮ ছাত্রছাত্রীর মৃত্যু হয়েছে। ২০২০ সালে এই সংখ্যা ৪৬ জন। পরিসংখ্যান এটাও বলছে, রেললাইনে মারা যাওয়া অধিকাংশ মানুষ শ্রমজীবী। ২০১৯ সালে ৪৩৩ জন শ্রমজীবী রেললাইনে লাশ হয়েছেন; ২০২০ সালে ৩৯৫ জন। এ ছাড়া ২০১৯ সালে ৮০ জন চাকরিজীবী রেললাইনে মারা গেছেন। ২০২০ সালে এ সংখ্যা ছয়জন।

পরিসংখ্যান বিশ্নেষণ করে দেখা যায়, রেললাইনে লাশ হওয়ার একটি বড় কারণ ‘অজ্ঞাত’। এর অর্থ, মৃত্যুর কারণ চিহ্নিত করতে না পারায় মৃত্যুর ‘দায়’ কার- এটা অজানা থাকছে। ২০১৯ সালে ৩৮৯ জনের মৃত্যুর কারণ চিহ্নিত করা যায়নি। ২০২০ সালে এই সংখ্যা ২১। রেললাইনে হাঁটার সময় কানে ইয়ারফোন দিয়ে কথা বলার কারণে ২০১৯ সালে ৩৭ জন মারা গেছেন। ২০২০ সালে এই সংখ্যা ৯। তথ্য বিশ্নেষণে এটাও দেখা যায়, রেলক্রসিং দ্রুত পার হতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হচ্ছে। ২০১৯ সালে এই সংখ্যা ৩৭২। ২০২০ সালে ৩৬৬ জন। প্রাণ যাওয়ার আরেকটি বড় কারণ হলো রেললাইনের ওপর দিয়ে বাস বা অন্যান্য যানবাহনের চলাচল। ২০১৯ সালে এই কারণে প্রাণ গেছে ৩৬৬ জনের। ২০২০ সালে এই সংখ্যা ২২৮। ট্রেনের ছাদ থেকে ‘পড়ার’ কারণেও অনেকে মারা যাচ্ছেন। এতে ২০১৯ সালে মারা গেছেন ১৪ জন, ২০২০ সালে দু’জন।

রেলওয়ে পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান, বেশ কিছু কারণে রেললাইনে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে রয়েছে সচেতনতার অভাব, অরক্ষিত ক্রসিং, অননুমোদিত ক্রসিং, গেটম্যান না থাকা, ঝুঁঁকিপূর্ণ লাইন ও সেতু এবং রেললাইন ঘিরে হাটবাজার।

সম্প্রতি রেললাইনে প্রাণ হারিয়েছেন অনেকে। রাজবাড়ীর কালুখালী উপজেলার কালিকাপুর রেলসেতুতে গত ৮ মার্চ বিকেলে ট্রেনের ধাক্কায় মারা যায় ইয়াসিন ফকির নামের দুই বছর বয়সী এক শিশু। শিশুটি রেললাইনের ওপর খেলার সময় এ দুর্ঘটনা ঘটে। এর ছয় দিন আগে ২ মার্চ একই রেলসেতুতে টিকটক ভিডিও তৈরি করতে গিয়ে প্রাণ হারায় আলহাজ হোসেন (১৫) নামের এক কিশোর। সে স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। ২৮ ফেব্রুয়ারি সকালে গাজীপুরের কালীগঞ্জে মোবাইল ফোনে কথা বলার সময় ট্রেনের ধাক্কায় আবদুস সালাম মুন্সী (৫০) নামের এক নির্মাণ শ্রমিক নিহত হন। উপজেলার আড়িখোলা রেলস্টেশনের অদূরে কাটারপাড় তুমুলিয়া রেলগেট এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে।

নাটোরের লালপুরে ট্রেনের ইঞ্জিনে কাটা পড়ে রাকিবুল ইসলাম ওরফে রকি (২০) নামের এক তরুণ নিহত এবং তার বন্ধু সাকিব হোসেনের এক হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ১৩ ফেব্রুয়ারি রাতে উপজেলার বিষপুর গ্রামের আবদুলপুর-আজিমনগর রেললাইনে এ দুর্ঘটনা ঘটে। তারা মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ট্রেন আসার শব্দ শুনতে পাননি।

৮ মার্চ সকালে রাজধানীর মগবাজারের পেয়ারাবাগে ট্রেনে কাটা পড়ে মো. রবিন (২০) নামের এক তরুণের মৃত্যু হয়। রেললাইন দিয়ে হাঁটার সময় তার কানে ইয়ারফোন ছিল। ১০ ফেব্রুয়ারি রাতে নাটোরে চলন্ত ট্রেনে ছিনতাইয়ে ব্যর্থ হয়ে ফয়সাল আহম্মেদ নামের এক যুবককে ট্রেন থেকে ফেলে হত্যার চেষ্টা করে দুর্বৃত্তরা। নাটোর রেলস্টেশনের অদূরে রেলগেট এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

এর আগে গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর চলন্ত ট্রেনে ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে দু’জন নিহত হন। তারা হলেন- নাহিদ মিয়া (৪০) ও সাগর মিয়া (২৫)। এ ঘটনায় রুবেল মিয়া নামের একজন আহত হন। সেদিন বিকেলে ছিনতাইকারীরা ময়মনসিংহের গফরগাঁও স্টেশনে দেওয়ানগঞ্জগামী জামালপুর কমিউটার ট্রেনের ছাদে ওঠে। ছাদে থাকা ওই তিন যাত্রী ছিনতাইয়ে বাধা দিলে তাদের ছুরিকাঘাত করা হয়। গত ২২ ভোরে ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের টঙ্গীতে অটোরিকশায় ট্রেনের ধাক্কায় নুরে আলম নোমান (৮) নামের এক শিশু মারা যায়। এ সময় অটোচালকসহ চারজন আহত হন। টঙ্গীর মধুমিতা রেলক্রসিং এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। ২২ ফেব্রুয়ারি সকালে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া জংশনে চলন্ত ট্রেনে উঠতে গিয়ে মরিয়ম (১০) নামের এক শিশুর ডান পায়ের নিচের অংশ কাটা পড়ে।

৪ মার্চ বিকেলে টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে ট্রেনের ধাক্কায় এক মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হন। তার নাম আবদুল্লাহ (৩৫)। উপজেলার সরাতৈল এলাকায় রাজশাহীগামী সিল্ক্কসিটি এক্সপ্রেসের ধাক্কায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। এতে তার বাবা মাওলানা আলাউদ্দিনও আহত হন।

২০১৬ সালে কুমিল্লায় রেললাইন থেকে শরিফুল ইসলাম নামের এক তরুণের লাশ উদ্ধার করা হয়। ট্রেনের ধাক্কায় তিনি মারা গেছেন উল্লেখ করে আদালতে প্রথমে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় রেলওয়ে পুলিশ। তবে ওই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি দেন তার বাবা। দীর্ঘদিন তদন্তের পর পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের তদন্তে উঠে আসে, প্রেম নিয়ে বিরোধের জেরে শরিফুলকে হত্যা করা হয়।