কল-কারখানার চাকা ঘুরছে, ঝড়ের গতিতে বেচাকেনা হচ্ছে নতুন নতুন অ্যাপার্টমেন্ট, বাড়ছে চাকরির সুযোগও। শুক্রবার চীনের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির খবর সামনে আসতেই দেখা যাচ্ছে এমন আকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য। করোনাভাইরাস মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে দেশটির অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে দ্রুততম সময়ে। এরপরও রয়েছে শঙ্কা। আর তা জাগাচ্ছে খোদ চীনা ভোক্তা এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা।
চীন জানিয়েছে, ২০২০ সালের প্রথম তিন মাসের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে তাদের অর্থনীতির আকার বেড়েছে একলাফে ১৮ দশমিক ৩ শতাংশ। প্রবৃদ্ধির এই হার যথেষ্ট আশাজাগানিয়া। করোনাভাইরাস মহামারি শুরুর দিকে ২০২০ সালের প্রথম প্রান্তিকে চীনা অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছিল ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। ফলে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি দ্রুতই মহামারিপূর্ব অবস্থায় ফিরছে- শুক্রবারের প্রতিবেদন সেদিকেই ইঙ্গিত করছে।
এক বছর আগেও অবরুদ্ধ ছিল গোটা চীন, বন্ধ ছিল উড়োজাহাজ চলাচল, রাস্তাঘাট, মহাসড়ক সবই বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে। এমন সময়ে বহু মানুষ ঘরে বসে কাজ করায় বিশ্বব্যাপী ব্যাপক চাহিদা বেড়ে যায় কম্পিউটার স্ক্রিন ও ভিডিও কনসোলের। আর সেগুলোর একটি বড় অংশই তৈরি হচ্ছে চীনে। তাছাড়া চীনাদের তৈরি আসবাবপত্র, বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিকস সরঞ্জামেরও ব্যাপক চাহিদা রয়েছে বিশ্বে।
চীনের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বড় অবদান রাখছে অবকাঠামো খাত। বিশাল বিশাল ভবন, সড়ক-মহাসড়ক ও রেলপথ নির্মাণ স্বল্পমেয়াদী চাকরির ব্যবস্থা করেছে। সম্পত্তি কেনাবেচা দেশটির অর্থনৈতিক কার্যক্রমের গতি বাড়িয়েছে।
তবে রফতানি এবং সম্পত্তির বিনিয়োগ চীনের প্রবৃদ্ধিকে টেনে তুলতে পারে এ পর্যন্তই। দেশটি এখন তার ভোক্তাদের মধ্যে করোনাপূর্ব সময়ের খরচের অভ্যাস ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে।
চলতি বছরের শেষের দিকে চীনের রফতানি পণ্যের চাহিদা কমে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ কারণে চীনা নীতিনির্ধারকরা সম্পত্তির বাজার এবং করপোরেট খাতের উত্তাপ কমাতে মনোনিবেশ করেছেন। অর্থনীতিবিদরা এখন এমন একটি বিস্তৃত পুনরুদ্ধার কৌশল খুঁজছেন, যা রফতানি ও সরকারের ওপর কম এবং গ্রাহকদের ওপর বেশি নির্ভর করবে।
টিকাদান কার্যক্রমে ধীরগতি এবং লকডাউনের তাজা স্মৃতির কথা মনে করে চীনা ভোক্তারা খরচ কমিয়ে দিয়েছেন। রেস্টুরেন্টগুলো এখনও আগের অবস্থায় ফিরতে লড়ছে। ওয়েটার, দোকানদার ও শিক্ষার্থীরা ‘প্রতিশোধমূলক ব্যয়’ শুরু করেননি। ভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর দ্রুতই লকডাউন দিয়েছিল চীনা কর্তৃপক্ষ। এতে চরম ক্ষতির মুখে পড়ে ক্ষুদ্র ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ক্রেতারা।
এসঅ্যান্ডপি গ্লোবালের এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রধান অর্থনীতিবিদ শন রোশে বলেন, চীনের পরিকল্পনা হচ্ছে কোভিড ফের দেখা দিলে দমন করা। কিন্তু স্বেচ্ছায় অনেককে সামাজিক দূরত্ব মানতে দেখা যাচ্ছে।
চীনের বৃহত্তম চাকরি বিষয়ক প্ল্যাটফর্ম ঝাওপিনের তথ্যমতে, এক বছর আগের তুলনায় বর্তমানে দেশটিতে হোটেল, রেস্টুরেন্ট, বিনোদন ও আবাসন খাতে অনেক বেশি চাকরির সুযোগ রয়েছে। তবে খরচাপাতির ব্যাপারে গৃহস্থালী খাত এখনও বেশ সতর্ক।
অক্সফোর্ড ইকোনমিকসের এশীয় অর্থনীতি বিভাগের প্রধান লুইস কুজিস বলেন, এখনও বহু লোক নির্দ্বিধায় ব্যয় করছেন না। কোভিডের কারণে কিছুটা দুশ্চিন্তা হয়তো রয়েছে, তবে সাধারণ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে।
উন্নত বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের মতো চীন ভোক্তাদের ভতুর্কি দেয়ার পথে যায়নি। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে চেক হস্তান্তরের বদলে দেশটি রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকগুলোকে ব্যবসায়িক ঋণদান ও কর মওকুফের আদেশ দিয়েছিল।
তাছাড়া, চীনা চান্দ্র নববর্ষের ছুটির সময় ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞাও সাধারণ মানুষের কেনাকাটার ক্ষুধা কমিয়ে দিয়েছে। অবশ্য শুক্রবারের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত মার্চ মাসে বেচাকেনার পরিমাণ প্রত্যাশার চেয়েও বেশি ছিল। ফলে আগামী মাসগুলোতে ক্রেতারা খরচের বিষয়ে আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবেন বলে আশা করা যায়।