গভীরভাবে না জানলেও বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেট সম্পর্কে জানাশোনা ছিল বিরাট কোহলির। সামর্থ্য নিয়ে তার কোনো সংশয় ছিল না। সংশয় ছিল টেস্ট ক্রিকেটের প্রতি নিবেদন নিয়ে। ইডেনে দিবারাত্রি টেস্ট জয়ের পর ভারতের অধিনায়ক বলেছিলেন, ‘টেস্ট ক্রিকেটকে ক্রিকেটাররা কতোটা গুরুত্ব দেয় তার উপর নির্ভর করবে অগ্রগতি।’
যে নিবেদন, গুরুত্বের কথা কোহলি বলেছিলেন সেগুলোর একমাত্র উদাহরণ মুমিনুল হক সৌরভ। যার উপস্থিতিতে সাদা পোশাকের ক্রিকেটে বাংলাদেশ পেয়েছিল সুবাতাস। ২২ গজে রানের ফোয়ারা ছুটিয়ে মুমিনুল আস্থা অর্জন করেছেন। টেস্ট স্পেশালিস্টের তকমা পেয়েছেন।
কিন্তু তার ছোট কাঁধে যখন গোটা দলের দায়িত্ব তখন মুমিনুল হারিয়ে গেলেন অথৈ সমুদ্রে। কুলকানারা হারিয়ে মুমিনুল দিকহারা এক জাহাজের নাবিক। যার নিজের সামর্থ্য নিয়েও উঠছে নানামুখী প্রশ্ন। হচ্ছে প্রবল সমালোচনা। তাইতো সেই দায়িত্বটা ছেড়ে দিয়ে ‘বাঁচলেন’ মুমিনুল।
অধিনায়কত্ব পাওয়া, অধিনায়কত্ব ছাড়া দুই সময়ের ব্যবধানে কেটেছে আড়াই বছর। এই আড়াই বছরের সফরে মুমিনুল শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছিলেন অপ্রস্তুত, ছিলেন খেয়ালী, ছিলেন ঢাল-তলোয়ারবিহনী এক যোদ্ধা, ছিলেন কল্পনাপ্রসূত।
সাকিবের নিষেধাজ্ঞায় মুমিনুল আচমকা দায়িত্ব পান। ‘উপায় না দেখে’ বিসিবির পছন্দ হয়ে উঠেন তিনি। দায়িত্ব পেয়ে মুমিনুল নিজেও অবাক হয়েছিলেন, তা স্বীকার করতে দ্বিধা করেননি, ‘সত্যি কথা বলতে কি আমি অধিনায়কত্ব করবো, সেজন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। কখনো ভাবিওনি বাংলাদেশের অধিনায়ক হবো।’
অপ্রস্তুত সেই যাত্রার শুরুটা ভারত সফর দিয়ে। যেখানে মুমিনুলকে পরতে পরতে পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়। ইন্দোর ও ইডেন টেস্টে বাজেভাবে হারের পর গোটা দল বুঝে যায় টেস্ট ক্রিকেটে কোথায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ। মুমিনুল নিজেও বুঝে যান অধিনায়কত্বের ঝাঁঝ। সেটা টসের সিদ্ধান্ত থেকে শুরু করে ম্যাচ রিপোর্ট দেওয়া পর্যন্ত। সফর শেষে তার শুনতে হয়, ‘বাংলাদেশ দল ‘অর্ডিনারি’, তাদের নিবেদন ‘অর্ডিনারি’, টেকনিক ‘অর্ডিনারি।’ বলেছিলেন সুনীল গাভাস্কার।
এরপর পাকিস্তান সফরে আবারও সেই অসহায় আত্মসমর্পণ। বাংলাদেশ যখন পাকিস্তানে তখন যুব দল দক্ষিণ আফ্রিকায় জেতে বিশ্বকাপ। দেশের ক্রিকেটে প্রথম বৈশ্বিক শিরোপা জেতা দলকে অভিনন্দন জানাতে গিয়ে মুমিনুল বেফাঁস বলে দেন, ‘যুব দল থেকেই আমাদের শেখা উচিত। তারা মাঠে যেভাবে লড়াই করেছে, যে ধৈর্য্য দেখিয়েছে সেটা আমাদের শেখা উচিত।’
তিন টেস্টে নেতৃত্ব দেওয়ার পর মুমিনুল ঘরের মাঠে জয়ের মুখ দেখে দুর্বল জিম্বাবুয়েকে হারিয়ে। এরপর কোভিডের ধাক্কা। মাঝে লম্বা বিরতির পর ওয়েস্ট ইন্ডিজকে আতিথেয়তা দিয়ে হিমশিম খায় মুমিনুলরা। চট্টগ্রাম ও ঢাকায় হেরে ২-০ ব্যবধানে সিরিজ হার। নিজেদের মাঠ, নিজেদের উইকেট, নিজেদের কন্ডিশন অথচ পরিকল্পনায় স্থির থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ উড়ায় বিজয়ের পতাকা।
এরপর পাল্লাকেল্লেতে গিয়ে সিরিজ হার, জিম্বাবুয়েতে সিরিজ জয় এবং পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ হারে মুমিনুলের ওপর চাপ বাড়তে থাকে। তবে এ বছর নিউ জিল্যান্ডে তার দল যা করে তাতে মুমিনুল পৌঁছে যান স্বপ্তমস্বর্গে। মাউন্ট মঙ্গানুই দুর্গ জয় করে তার দল। যা ছিল নিউ জিল্যান্ডের মাটিতে বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ জয়।
এরপর শুধু ব্যর্থতা আর ব্যর্থতা। যে মিছিল ক্রমেই লম্বা হতে থাকে, বাড়তে থাকে সমালোচনার স্তুপ। যেখানে সামান্যতম সাফল্য আড়াল হয়ে যায়। অস্তমিত হয় ব্যক্তিত্বের সূর্য। শুধু মাঠের সাফল্য-ব্যর্থতায় নয়, মাঠের বাইরেও মুমিনুল হতে পারেন না আদর্শ নেতা। তার কথায় ফুটে উঠে দল পরিচালনার বিশাল ঘাটতি। পরিসংখ্যানটাও সাদামাটা, ১৬ টেস্টে তিন জয়ের বিপরীতে হারই ১২টি। ড্র আছে ২টি।
দল পরিচালনার চাপে ব্যাটসম্যান মুমিনুলও হারিয়ে যান। অধিনায়কত্ব মুমিনুলের পারফরম্যান্সে কতোটা প্রভাব ফেলেছে তা এ পরিসংখ্যানে স্পষ্ট হবে। অধিনায়ক হিসেবে ১৭ ম্যাচে মুমিনুলের রান ৯১২। ব্যাটিং গড় ৩১.৪৪। পেয়েছেন ৩ সেঞ্চুরি। অধিনায়কত্বের আগে ৩৬ টেস্টে ৪১.৪৭ গড়ে রান করেছেন ২৬১৩। সেঞ্চুরি ছিল ৮টি।
বিষাদমাখা অধিনায়কত্বের সফরের শুরুটা মুমিনুল লেখেননি। তবে শেষ করলেন মুমিনুল। অধিনায়ক মুমিনুলের থেকে ব্যাটসম্যান মুমিনুলকেই খুব প্রয়োজন বাংলাদেশের।