অনুমতি ছাড়া ফেসবুকে ভিডিও দিতে পারবে না পুলিশ

লেখক:
প্রকাশ: ৬ years ago

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম-ফেসবুকে প্রায়ই ভিডিও আপলোড করতে দেখা যায়। এর কোনোটি ব্যক্তিগত ‘সুনাম’ আবার কোনোটি অন্যের ‘দুর্নাম’ ছড়ানোর জন্য।

সম্প্রতি রাজধানীর রামপুরায় পুলিশ চেকপোস্টে এক তরুণীকে হয়রানি এবং সেই ভিডিও পোস্ট করায় তীব্র সমালোচনায় পড়ে পুলিশ। তদন্ত শুরু হয় অভিযুক্ত পাঁচ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে।

তবে এ ধরনের ঘটনা এটাই প্রথম নয়। এর আগেও পুলিশ সদস্যরা বিভিন্ন ঘটনার ভিডিও ফেসবুকে দিয়ে সুনাম অর্জনের চেষ্টা করেছেন। তবে এবারের ঘটনা নাড়া দিয়েছে গোটা বাহিনীকে। এর স্থায়ী সমাধান হিসেবে পুলিশ সদস্যদের ফেসবুক ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ আনা হচ্ছে। ফেসবুকে কোনো ভিডিও আপলোড করতে হলে ঊর্ধ্বতন অফিসার অথবা ইউনিট প্রধানের অনুমতি লাগবে।

শনিবার (২৭ অক্টোবর) পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) সোহেল রানা বলেন, ‘একজন পুলিশ কর্মকর্তা তার ইউনিট প্রধানের অফিসিয়াল অনুমতি ছাড়া ব্যক্তিগত ধারণকৃত ভিডিও ফেসবুকে আপলোড করতে পারবেন না। সেটি জনকল্যাণমূলক কিংবা অপারেশনাল যে ধরনের ভিডিওই হোক না কেন। যে কাউকে এ ধরনের ভিডিও আপলোড এবং শেয়ার করার আগে প্রোপার চ্যানেলে (নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায়) অনুমতি নিতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারে পুলিশ সদস্যদের আগে থেকেই সতর্ক হওয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। ২-১ দিনের মধ্যে আবারও নতুন করে অফিসিয়াল আদেশ দেয়া হবে।’

সম্প্রতি রাজধানীর রামপুরা চেকপোস্টে কয়েকজন পুলিশ সদস্যের হাতে এক নারী হয়রানির ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ায় সমাজে তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ভিডিওটি আপলোড করেন এক পুলিশ সদস্য। এতে একজন নারীকে তল্লাশি না করে অপ্রাসঙ্গিক ও আজেবাজে মন্তব্য করতে শোনা যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ রকম অসংবেদনশীল আচরণের জন্য পুলিশের সমালোচনা করে সাধারণ মানুষ।

এ ঘটনায় রামপুরা থানার সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) ইকবাল হোসেন ও মিরপুরের পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্টের (পিওএম) চার কনস্টেবল রকিবুল, জিতু, তৌহিদুল ও মিজানুরকে শনাক্ত করে বিভাগীয় তদন্ত শুরু হয়েছে। পাশাপাশি দায়িত্ব থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে টিম লিডার এএসআই ইকবাল হোসেনকে।

এ বিষয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, ‘যে এ ভিডিওটি ধারণ করে ফেসবুকে আপলোড করেছেন তিনিও পুলিশেরই সদস্য। তিনি ভেবেছিলেন ওই ভিডিওটা প্রকাশ করলে তার হয়তো সুনাম হবে।’

তবে ‘সুনাম অর্জনের’ জন্য পুলিশের এ ধরনের কাজকর্ম এটাই প্রথম নয়। চলতি বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মিরপুর ১৩ নম্বরে স্কলাস্টিকা স্কুলের সামনে পুলিশের প্রতি ‘সরকারদলীয় এমপির মেয়ে’ দাবি করা এক নারীর আগ্রাসী আচরণের ভিডিও ফেসবুকে আপলোড করেন ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট ঝোটন সিকদার। ভিডিওটি দেখে অনেকেই ওই নারীকে নিয়ে কটূক্তি করেন। তবে ভিডিওটিতে নারীর অসদাচরণের আগের কোনো চিত্র ছিল না। ঘটনার প্রেক্ষাপটটিও উল্লেখ করা হয়নি ভিডিওতে।

এ ছাড়া চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি রাতে রাজধানীর বেইলি রোডের সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজের সামনে গাড়িতে চড়ে উল্টোপথে ফিরছিলেন একজন সাংবাদিক নেতা ৷ সার্জেন্ট কাওসার হামিদ গাড়িটি আটকে দিলে তার সঙ্গে ওই সাংবাদিক নেতার কথা কাটাকাটি হয়। সেটি এক প্রত্যক্ষদর্শী ভিডিও করে ফেসবুকে দিয়েছিলেন। ভিডিওটি দেখে অনেকেই সাংবাদিক নেতা ও সাংবাদিকদের তীব্র সমালোচনা করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, পুলিশের বিপিএম ও পিপিএম পদক, আইজিপি ব্যাচ ইত্যাদি অর্জনের জন্য সদস্যদের ভালো কাজের উদাহরণ দিতে হয়। অনেকেই নানা ধরনের ‘জনকল্যাণমূলক’ কাজ করে সেগুলো ফেসবুকে ছড়িয়ে দিতে চান। এ ভিডিওটি তারই একটি অংশ।

এ ধরনের ঘটনা সমাজে নাগরিকদের সম্মানহানি ঘটায় উল্লেখ করে সমাজ বিজ্ঞানীরা এ প্রবণতাকে অনৈতিক বলে উল্লেখ করেন।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘যে সমস্ত বাহিনীগুলো শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে কাজ তাদের একটা নৈতিক মানদণ্ড রয়েছে। পুলিশ বাহিনীও এ মানদণ্ডের বাইরে নয়। তাদের পেশাগত অনুশীলন, ওরিয়েন্টেশন, প্রফেশনাল কোড অব ইথিকস মেনে প্রতি সদস্যকে দায়িত্ব পালন করতে হয়। নাগরিকদের সঙ্গে পুলিশের এমন আচরণ পেশাদারী মনোভাবের প্রকাশ করে না।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের সহকারী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক  বলেন, ‘সম্প্রতি এক তরুণীর সঙ্গে রাতে তল্লাশির নামে যে ধরনের আচরণ হয়েছে, তাতে পুলিশের পেশাদারিত্বের অভাব ও প্রশিক্ষণহীনতা প্রকাশ পায়। যদিও পুলিশ প্রশাসন পাঁচজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। কিন্তু এ ধরনের মনোভাবসম্পন্ন পুলিশ আরও অনেক রয়েছে। পুলিশ সদস্য ইউনিফর্ম পরা অবস্থায় তল্লাশি করে কিছু না পাওয়া কিংবা না পাওয়া গেলেও এর ভিডিও প্রকাশ করলে ওই ব্যক্তির ইমেজ এবং সামাজিক অবস্থানের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। পুলিশকে সব সময় তল্লাশি ও আচার আচরণে সতর্ক হতে হবে। অন্যথায় পুলিশের সঙ্গে সাধারণ মানুষের দীর্ঘদিনের বিশ্বাসের সংকট বড় হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এ ধরনের আচরণের কারণে পুলিশ প্রশাসন নাগরিকদের কাছে যেতে পারছে না। সাধারণ নাগরিক তাদের আপন করে নিচ্ছেন না। যারা আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করবে তারাই যদি আইন ভাঙে। তবে সমাজে অপরাধ ও অপরাধী বাড়বে।’