ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার বাদুরতলা গ্রামের মৃত তসলিম হাওলাদারের ছেলে মোদাচ্ছের আলী এক মেয়ে ও দুই ছেলের বাবা। বড় ছেলে ঢাকায় একটি তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করে। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন।
ছোট ছেলে কামাল হোসেন বাদুরতলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র। ছোট ছেলেই এখন তার একমাত্র সম্বল। তাকে সঙ্গে নিয়েই নদীতে মাছ ধরা অথবা দিনমজুরি দেয়ায় তার কাজ।
বিষখালী নদীর বাদুরতলা অংশে ইলিশ শিকারের সংবাদ সংগ্রহে গিয়ে কথা হয় মোদাচ্ছের আলীর সঙ্গে। আইন অমান্য করে সবাই যখন নদীতে মাছ ধরছিল তখন তিনি সবাইকে আইন মানতে উৎসাহ দিচ্ছিলেন। সময় পেলেই তিনি নদীর পাড়ে এসে বসেন। একদিকে বিষখালী নদী তার রোজগারের মাধ্যম অপরদিকে এ নদীতেই বিলীন হয়েছে তার সহায় সম্বল।
জাটকা ইলিশ শিকারে সরকারের নিষেধাজ্ঞা থাকায় এর মধ্যে একদিনও নদীতে মাছ শিকারে নামেননি তিনি। ঘরে খাবার নেই গত কয়েক দিন ধরে। তবুও নৌকাটি ডাঙায় তুলে রেখেছেন।
অনাহারে থেকে মরে গেলেও আইন অমান্য করবেন না এমন প্রতিজ্ঞা তার। পুরো নাম মো. মোদাচ্ছের আলী হাওলাদার। বয়স ৬৫। আইন অমান্য করবেন না- এমন প্রতিজ্ঞা করে অনাহারে জীবন চলছে তার। আশপাশের সবাই যখন উৎসব করে জাটকা ইলিশ শিকারে ব্যস্ত তখন তিনি আইন মেনে ঘরে বসে থাকেন কিংবা নদীর পাড়ে গিয়ে একা বসেন।
স্থানীয় জেলে ইলিয়াস হোসেন বলেন, মোদাচ্ছের চাচাকে কোনোদিনই নিষেধাজ্ঞার সময় মাছ ধরতে দেখিনি। তিনি সবাইকে আইন মানতে বলেন। আইন মানা সব নাগরিকের জন্য দায়িত্ব বলে মনে করেন তিনি। সবাই আইন না মানলেও তাকে দেখে কিছু মানুষ উৎসাহিত হয়েছে। অনেকে তার কথায় বিরক্ত হলেও একরোখা প্রকৃতির মোদাচ্ছের চাচাকে এলাকার সবাই ভালোবাসে।
অভাবের সংসার কীভাবে চলে জানতে চাইলে মোদাচ্ছের আলী বলেন, গাঙ্গে সরকার অবরোধ দেয়ায় মাছ ধরি না। দিনমজুরি কইর্যা যা পাই তাই দিয়া সংসার চালাই। পাঁচদিন কাম করেছি। দুই আজার (হাজার) টাকা পাইছি। চাল আর মোডা ডাল কিনছি, বাকিটা আল্লা ভরসা। গত কয়দিন কাজ নাই। তাই ঘরে খাবার নাই। তবুও নদীতে নামবো না।
মোদাচ্ছের আলী বলেন, নিজেগো বাড়ি, চাষের জমি, গরু-বাছুর সবই আছিল। কিন্তু বিষখালী সব খাইছে। গত ৪০ বছরে সাড়ে পাঁচ বিঘা জমি বসতবাড়ি সবই গাঙ্গের প্যাডে (পেটে) গেছে। নিজের বলতে আর কিছু নাই।
সরকারি কোনো সাহায্য পেয়েছেন কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যার ঘরে ভাত আছে সে সরকারি চাল পায়। যার নিজের জমি আছে হে ভূমিহীনের জমি পায়। যারা আসল জাইল্যা (জেলে) হেরা কার্ড পায় না। মেম্বারের লগে দ্যাহা অইলেই কয় দিমুনে। কিন্তু দেয় না। কিছু না পাইলেও অবরোধে মাছ ধরমু না। মোর রিজিকের মাছ গাঙ্গে আছে। অবরোধ উঠলে পরে ধরমু। সবাইরে মাছ ধরতে নিষেধ করি। কিন্তু ওরা অবরোধের মধ্যেও মাছ ধরে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপকূলের জেলেদের ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় ২০ কেজি করে চাল দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
ঝালকাঠি জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, বরাদ্দের এসব চাল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হয়ে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের মাধ্যমে জেলেদের মধ্যে বিতরণ করা হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজাপুর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মুক্তা রানী সরকার বলেন, রাজাপুর উপজেলায় এক হাজার ১৪৭ জন নিবন্ধিত জেলে রয়েছে। বছরে তারা চার মাস সরকারি চাল পায়। বর্তমানে মাছ ধরার ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞার জন্য সরকার অতিরিক্ত চাল বরাদ্দ করেছে। জেলেরা শিগগিরই সেই চাল পাবে।
মঠবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল সিকদার বলেন, এমন একজন আইন মান্যকারী ভালো মানুষ সরকারি সাহায্য পাবে না তা হয় না। আমি অবশ্যই ওই এলাকার ইউপি সদস্যের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলব এবং তার জন্য সরকারি সাহায্যের ব্যবস্থা করব।