মুক্তিযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ১৯৭২ সালে বলেছিলেন, বাংলাদেশ ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হতে যাচ্ছে। আর ২০২১ সালে জাতিসংঘ ঘোষণা দিল, বাংলাদেশ ‘উন্নয়নশীল’ দেশ হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে। এর চেয়ে সুখের সংবাদ কী হতে পারে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মাইলফলকে পৌঁছানোর বছরে! এই একটি খবরেই যেন বাঙালির শত বেদনা উবে গেছে। অর্জনের ইতিহাসে নয়া এই সংযোজনের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার আত্মমর্যাদাই তুলে ধরেছে বিশ্ব পরিসরে।
মাত্র ৫০ বছর। তাতেই ভুল প্রমাণিত হয়েছে হেনরি কিসিঞ্জারের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র তকমা। ভিখারির অভিশাপ থেকেও মুক্ত বাংলাদেশ। ‘অগ্রগতির সুবর্ণরেখা’য় নতুন এক বাংলাদেশের পরিচয় মিলছে এখন।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যে বাংলাদেশের সৃষ্টি, তারই কন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে সে বাংলাদেশের আজ নতুন পরিচয়। উন্নয়ন প্রশ্নে বাংলাদেশ এখন নিজস্ব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারে। পদ্মাসেতু নির্মাণের প্রশ্নে বিশ্ব ব্যাংককে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে অন্তত সেটাই প্রমাণ করেছে বাংলাদেশ।
রক্তের সাগর পাড়ি দিয়ে যে দেশের জন্ম, সে দেশের মানুষকে দমায় কে! ঘাম ঝরানো শ্রমে এখানকার মানুষ রোজ স্বপ্ন বুনছে এগিয়ে যাওয়ার।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, ১৯৭৩-১৯৭৪ অর্থবছরে এ দেশের রফতানি আয় ছিল ২৯৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর এখন (২০২০ সাল) রফতানি আয় দাঁড়িয়েছে ৩৯ দশমিক ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ১৯৭৩-১৯৭৪ সালে জিডিপির আকার ছিল ৭ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রায় ২৭ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা জিডিপির আকার হয়েছে। ওই সময় মাথাপিছু আয় ছিল ১২৯ ডলার। এখন মাথাপিছু আয় দুই হাজার ৬৪ ডলার। ১৯৭৩-১৯৭৪ অর্থবছরে দারিদ্র্যের হার ছিল ৭০ শতাংশ। সেই হার কমে এখন দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ৫ শতাংশে।
জাতিসংঘের দেয়া তিন শর্ত মেনে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকাভুক্ত হয় ১৯৭৫ সালে। ২০১৮ সালেই ওই তিন শর্ত পূরণ করে বাংলাদেশ। জাতিসংঘ এ বছর সেই স্বীকৃতি দিয়ে জানায়, তিনটি শর্ত পূরণে প্রয়োজনীয়তা দক্ষতা দেখিয়েছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের শর্ত পূরণে ন্যূনতম মাথাপিছু আয় এক হাজার ২৩০ ডলার দরকার হয়। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এখন দুই হাজার ৬৪ ডলার। অর্থনৈতিক ঝুঁকি নির্ধারণ করা আছে ১০০ স্কোরের মধ্যে ৩২ এর নিচে স্কোর হতে হবে। বাংলাদেশের স্কোর ২৫.২। আর মানবসম্পদ উন্নয়ন যোগ্যতায় বাংলাদেশের স্কোর ৭৩.২ এর কোটায়। যেখানে নির্ধারণ করা আছে ৬৬।
সবমিলিয়ে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে যেন এক পরিণত বাংলাদেশকে দেখছে বিশ্ব। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের ভাষায়, ‘অর্থনীতিতে বাংলাদেশের গুণগত উন্নয়ন ঘটেছে, এটি সহজেই দৃশ্যমান। বিভিন্ন সূচক তার প্রমাণ। আমরা এই সময়ে একটি ল্যান্ডমার্ক অতিক্রম করেছি। উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় বাংলাদেশ, এটি অবশ্যই আনন্দের কথা। কিন্তু চ্যালেঞ্জগুলোও আমলে নিতে হবে। সংকটগুলোও দেখতে হবে। আমাদের কোথায় যাবার কথা ছিল, আর কোথায় যেতে পারলাম, তার হিসাবটাও গুরুত্ব দিতে হবে। বেসরকারি বিনিয়োগে স্থবিরতা, রফতানি তুলনামূলক না বাড়া, রেমিট্যান্স কমে যাওয়া, মানবসম্পদ না বাড়া, শিক্ষার মানোন্নয়ন না হওয়া, শিক্ষিত বেকার বৃদ্ধি পাওয়া, দারিদ্র্য, আয় বৈষম্যের মতো বিষয়গুলো আমাদের নিয়মিত চ্যালেঞ্জ। এর সঙ্গে শুল্কমুক্ত সবিধা না পাওয়া এবং ব্যাংক সুদের হার বৃদ্ধি পাওয়ার মতো চ্যালেঞ্জগুলো নতুন করে যোগ হচ্ছে।’
বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার পেছনে প্রধানতম কারিগর শ্রমজীবী মানুষ, এমনটি উল্লেখ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘সাধারণ কৃষক-উদ্যোক্তা, পোশাক শ্রমিক, প্রবাসী শ্রমিকরা আজকের বাংলাদেশকে দাঁড় করিয়েছে। বরং অপরাজনীতি, দুঃশাসন সাধারণ মানুষের এগিয়ে যাওয়ার বেলায় বারবার অন্তরায় হয়েছে। শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন দিয়েই আপনি সামগ্রিক উন্নয়নের মূল্যায়ন করতে পারবেন না। আত্মমর্যাদাশীল একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পেতে গেলে মানবিক উন্নয়নকেও গুরুত্ব দিতে হবে।’
অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘৫০ বছরে বাংলাদেশ অবশ্যই অগ্রযাত্রার কথা বলে, উন্নয়নের কথা বলে। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের যোগ্যতা অর্জন করেছে বলে জাতিসংঘ যে ঘোষণা দিয়েছে, তা অবশ্যই এ দেশের মানুষের শ্রমের স্বীকৃতি বলে মনে করি। তবে বাংলাদেশের এই অর্জন বিশেষ কোনো সরকারের নয়। সরকারগুলোর নীতি এবং মানুষের চেষ্টার ফলেই আজকের বাংলাদেশ। ১৯৯০ সাল থেকে একটা ফ্লো তৈরি হয়েছে। নানা সরকারের সময়ে একটু একটু করে এগিয়ে এটাকে গতিশীল করেছে। এই গতি হয়তো কখনো কমেছে, কখনো বেড়েছে। তবে সাধারণ মানুষের এগিয়ে যাওয়ার ধারাবাহিকতা ছিল।’
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘আমাদের অর্জন নিয়ে বসে থাকলেই চলবে না। বরং নানা কারণে চ্যালেঞ্জ সামনে এসেছে এখন। দক্ষতার সঙ্গে এগুলো মোকাবেলা করতে না পারলে অর্জনগুলো ম্লান হতে পারে। সংকটগুলো কোথায়, তা বের করতে হবে। সুশাসন-গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না থাকলে অর্থনীতি ভেঙে পড়ার ঝুঁকি থেকেই যায়। আমরা এই প্রশ্নে এখন কোথায় আছি, তার সমাধান টানতে হবে।’