 
                                            
                                                                                            
                                        
বহু জল্পনা কল্পনা আর উদ্বেগের পর শুরু হয়েছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ। ঘড়ির কাঁটায় সকাল ৮টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে সারাদেশে একযোগে ভোটগ্রহণ শুরু হয়েছে। ভোটগ্রহণের আগে গত কয়েক ঘণ্টায় দেশের বিভিন্ন স্থানে নাশকতার ঘটনা ঘটায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রায় আট লাখ সদস্য কেন্দ্র ও কেন্দ্রের বাইরে পাহারায় রয়েছে। কড়া নজরদারি গোয়েন্দাদের।
সরকারের পক্ষ থেকে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয় আর তা বাস্তবায়নে মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রায় আট লাখ সদস্য। যা গত একাদশ সংসদ নির্বাচনের চেয়ে এক লাখ ৩০ হাজার বেশি।
এদিকে ‘একতরফা’ নির্বাচন বর্জন ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে সারাদেশে বিএনপির ডাকা ৪৮ ঘণ্টার সর্বাত্মক হরতাল কর্মসূচি চলছে। ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী, শনিবার (৬ জানুয়ারি) ভোর ৬টা থেকে সোমবার (৮ জানুয়ারি) ভোর ৬টা পর্যন্ত এ কর্মসূচি চলবে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত করার জন্য যা যা করা প্রয়োজন সবকিছু করা হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। কেউ নাশকতা করে পার পাবে না। ইউনিফর্মে বিভিন্ন বাহিনীর সদস্য এবং সাদা পোশাকে ভোটকেন্দ্রের আশপাশেসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে গোয়েন্দারা কাজ করছে। এছাড়া হরতালের নামে যদি কেউ নাশকতা করার চেষ্টা করে তবে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রেও বাধা দিলে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ নির্বাচনে যেমন বিএনপি নেই, তেমনি নেই আরও কিছু উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক দল। ফলে এই নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মাঠে নামিয়ে নির্বাচন জমজমাট করার চেষ্টা করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এর বাইরে জাতীয় পার্টি ছাড়াও নির্বাচনে আছে বেশকিছু দল।
নাশকতাকারীর তথ্য দিলে ‘লাখ টাকা পুরস্কার’-
নির্বাচনে দেশের কোথাও নাশকতাকারীদের সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিলে ২০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত পুরস্কার দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। তথ্য প্রদানকারীর পরিচয় গোপন রাখা হবে বলেও জানান তিনি।
২৪ ঘণ্টায় ১৪ জেলায় ২১ ভোটকেন্দ্রে আগুন-
শনিবার রাত ১০টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় দেশের অন্তত ২২ জেলায় ৪১টি অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ১৪ জেলার ২১টি ভোটকেন্দ্রে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। একই সময় চার জেলায় চার নির্বাচনী ক্যাম্প ও দুই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সাত জেলায় ১১টি যানবাহন ও তিন জেলায় অন্তত তিনটি স্থাপনায় (ভোটকেন্দ্র নয় এমন বিদ্যালয়) আগুন লাগানো হয়েছে। এ ছাড়া দুই জেলায় ভাঙচুর করা হয়েছে ২২টির মতো যানবাহন।
বিরোধীদের এ কর্মসূচি চলাকালে শনিবার বগুড়ায় পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতাকর্মীদের সংঘর্ষ ও গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটে। নোয়াখালীতে দলটির নেতাকর্মীদের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের। আর রাজশাহী, কুমিল্লা ও লক্ষ্মীপুরে বেশ কয়েকটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটে। চট্টগ্রামের দুই স্থানে ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কে ত্রিভুজাকৃতির লোহার পাত ফেলে রাখায় চাকা পাংচার হয়ে বিকল হয় ৮০টির মতো যাত্রীবাহী ও পণ্যবোঝাই গাড়ি।
রেকর্ড সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তবুও শঙ্কায় ভোটাররা-
এই নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রায় আট লাখ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। এর মধ্যে পুলিশের এক লাখ ৭৪ হাজার ৭৬৭ জন, আনসার ব্যাটালিয়নের ৫ লাখ ১৪ হাজার ২৮৮, সশস্ত্র বাহিনীর ৪০ হাজার সদস্য মোতায়েন রয়েছেন। ভোটগ্রহণ ঘিরে এমন নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হলেও মাঠ পর্যায়ে উত্তাপ ও সংশয় দুই-ই বিরাজ করছে। এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভোটকেন্দ্রে হামলা ও আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। অনেক স্থানে প্রতিপক্ষ প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের ভয় দেখানো, ক্যাম্প ভাঙচুরসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। গত শুক্রবার (৫ জানুয়ারি) রাতে রাজধানীর গোপীবাগে আন্তঃনগর বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে দেওয়া আগুনে ঝরেছে চারজনের প্রাণ।
৪২ হাজার ভোটকেন্দ্রে নিরাপত্তা বলয়-
নির্বাচনে ৪২ হাজার ২৪টি ভোটকেন্দ্র ও দুই লাখ ৬০ হাজার ৮৫৬টি ভোটকক্ষ রয়েছে। ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তায় পুলিশ-আনসারের ১৫-১৭ জন সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন। ভোটকেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রায় পৌনে সাত লাখ সদস্য শুক্রবার মাঠে নেমেছেন। এদিন ৬৫৩ জন জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটও নেমেছেন। তারা নির্বাচনী অপরাধ দেখলে তাৎক্ষণিক সংক্ষিপ্ত পদ্ধতিতে বিচার করবেন।
ভোটে চালকের আসনে ৬৬ রিটার্নিং অফিসার-
ভোট নির্বিঘ্ন ও সুষ্ঠু করতে চালকের ভূমিকায় ৬৬ জন রিটার্নিং কর্মকর্তা। এর মধ্যে আছেন ৬৪টি জেলার ৬৪ জন জেলা প্রশাসক এবং ঢাকা ও চট্টগ্রামের দুজন বিভাগীয় কমিশনার। ৪২ হাজারের ভোটকেন্দ্রে রিটার্নিং অফিসার থেকে শুরু করে পোলিং অফিসার পর্যন্ত লক্ষাধিক নির্বাচনী কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করবেন। তার মধ্যে রয়েছেন ৬৬ জন রিটার্নিং অফিসার, ৫৯২ জন সহকারী রিটার্নিং অফিসার এবং ৪২ হাজার ১৪৯ জন প্রিসাইডিং অফিসার। নির্বাচন কমিশনের আইন অনুযায়ী, নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি অর্গানোগ্রাম অনুসরণ করা হয়। রিটার্নিং অফিসারদের তত্ত্বাবধানেই সার্বিক ভোট প্রক্রিয়া পরিচালিত হয়।
এ বিষয়ে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, যারা নির্বাচনে নাশকতার চেষ্টা করবে, মানুষের জানমালের ক্ষতি সাধনের চেষ্টা করবে, যারা রাষ্ট্রীয় সম্পদ নষ্ট করবে, তাদের কঠোরভাবে দমন করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। সুষ্ঠু ও নিরাপদে যাতে ভোটাররা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে ভোটকেন্দ্রে যেতে পারে সেই এই লক্ষ্যে র্যাব কাজ করছে। আমরা প্রতিটি গোয়েন্দা সংস্থাসহ অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে, রিটার্নিং অফিসার সহকারী রিটানিং অফিসার এবং নির্বাচনের কাজ করে যাচ্ছি।
কমান্ডার মঈন বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় যে স্ট্রেনথ আমাদের ইন্টেলিজেন্ট আমাদের গোয়েন্দারা কাজ করছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অনেকেই নাশকতার চেষ্টা করছে। নির্বাচনে যারা নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে চাচ্ছেন তাদের বাধা দান করা বা নাশকতা সহিংসতার মতো বেশকিছু ঘটনা ঘটেছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে অনেককেই আমরা আইনের আওতায় নিয়ে এসেছি।
বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল একেএম আমিনুল হক জানান, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, ভোটকেন্দ্র ও ব্যালট বাক্সের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং ভোটদানে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সারাদেশে পাঁচ লাখ ১৭ হাজার ১৪৩ জন সদস্য মোতায়েন করেছে বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী, সারাদেশে ৪২ হাজার ১৪৯টি ভোটকেন্দ্রের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও ব্যালট বাক্সের নিরাপত্তা রক্ষায় পাঁচ লাখ পাঁচ হাজার ৭৮৮ জন সাধারণ আনসার ও ভিডিপি সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।
বিজিবি মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল এ কে এম নাজমুল হাসান জানান, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করতে এবং শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় রাজধানীসহ সারাদেশে এক হাজার ১৫৫ প্লাটুন বিজিবি সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। আমাদের মোতায়েন করা জনবল সারাদেশে ৪৮৭টি বেইজ ক্যাম্প থেকে দায়িত্ব পালন করছে। বিজিবির ৭০০ পেট্রোল দিন-রাত টহল দিচ্ছে।
তিনি বলেন, সারাদেশে বিজিবির র্যাপিড অ্যাকশন টিম (র্যাট), ডগ স্কোয়াড কাজ করছে। এছাড়া, আমাদের কুইক রেসপন্স টিম প্রস্তুত আছে। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় এই টিমের সদস্যদের হেলিকপ্টারের মাধ্যমে দ্রুত সময়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
জানতে চাইলে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, নির্বাচনী দায়িত্ব পালনের জন্য পুলিশ-আনসার, প্রিসাইডিং অফিসার, পুলিং অফিসারা কাজ শুরু করেছেন। সশস্ত্র বাহিনী, বিজিবি, র্যাব মোতায়েন করা হয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেট, প্রশাসন মিলে আমরা নির্বাচন কমিশনের অধীনে সবাই মিলে দায়িত্ব পালন করছি। আশা করি সুষ্ঠুভাবে নির্বাচনী দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে সক্ষম হবো।
আইজিপি বলেন, স্ট্রাইকিং টিম, রিজার্ভ ফোর্স, মোবাইল টিম, কুইক রেসপন্স টিম, ডগ স্কোয়াড, র্যাবের হেলিকপ্টারসহ সমগ্র জনবল নিয়ে প্রস্তুতি রয়েছে। নির্বাচন ঘিরে যে কোনো নাশকতা করলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নাশকতাকারীর তথ্য দিলে ২০ হাজার থেকে লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। তথ্যের গুরুত্ব অনুসারে সেই পুরস্কারের অর্থ ২-৩ লাখও হতে পারে। তবে তথ্য দাতার পরিচয় গোপন রেখে, নাশকতাকারীর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।