স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনে জাতীয় নাগরিক কমিটির প্রস্তাব

লেখক:
প্রকাশ: ১২ ঘন্টা আগে

স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশনে জাতীয় নাগরিক কমিটির প্রস্তাব হস্তান্তর করা হয়েছে। জাতীয় নাগরিক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ডা. তাসনিম জারার নেতৃত্বে সংস্কার প্রস্তাব পেশ করা হয়।

মঙ্গলবার (৪ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে শহীদ আবু সাঈদ ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টারে স্বাস্থ্যখাত সংস্কার কমিশন কার্যালয়ে সংস্কার প্রস্তাব পেশ করা হয়।

জাতীয় নাগরিক কমিটির সংস্কার প্রস্তাব হস্তান্তর শেষে ডা. তাসনিম জারা বলেন, যদি কারো জরুরি অবস্থা হয় বা টাইম ক্রিটিক্যাল অবস্থা হয়, যেমন হৃদ্‌রোগ, স্ট্রোক, তখন দ্রুততম সময়ে কীভাবে সেবা নিশ্চিত করা যায়, সেই ব্যাপারে চিকিৎসার স্ট্রাকচার কেমন হবে, মেকারিজম কেমন হবে, সেটা নিয়ে আমরা প্রপোজাল দিয়েছে। প্রত্যেকটা রোগীর জন্য ন্যাশনাল ইলেকট্রনিক্স হেলথ রেকর্ড তৈরি করার জন্য আমরা প্রপোজাল দিয়েছি।

তিনি আরও বলেন, আমাদের স্বপ্ন হচ্ছে কারো পকেটে কত টাকা আছে চিকিৎসার ক্ষেত্রে যেন বাধা না হয়। তার রোগ অনুযায়ী সে চিকিৎসা পাবেন। তার পকেটের টাকা আছে কি-না, সে কৃষক নাকি মন্ত্রী তা দেখা হবে না, তার চিকিৎসা হবে রোগ অনুযায়ী। এটা আমরা স্বপ্ন দেখি।

ডা. তাসনিম জারা বলেন, আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গবেষণা কীভাবে বিশ্বমানের হতে পারে, কীভাবে ইনফা স্ট্রাকচার তৈরি হবে, বায়ু ব্যাংক পড়া, সে ব্যাপার আমার প্রপোজাল দিয়েছি। স্বাস্থ্য আমাদের অধিকার, সুস্বাস্থ্য না থাকলেও কীভাবে আমরা আগাবো? স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি এবং যে প্রপোজাল দিয়েছি সেটা স্বল্প মেয়াদ এবং দীর্ঘমেয়াদি বাস্তবায়ন করতে হবে। আজকে আমরা শুরু করেছি। এটা বাস্তব আর না হওয়া পর্যন্ত আমরা সফলভাবে থাকবো।

জাতীয় নাগরিক কমিটির স্বাস্থ্যখাত সংস্কার প্রস্তাবনায় সাতটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। সেগুলো হলো-

১. জরুরি স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়ন ও আধুনিক অ্যাম্বুলেন্স সিস্টেম : বাংলাদেশে জরুরি চিকিৎসা ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। অনেক রোগী সময়মতো অ্যাম্বুলেন্স পান না, হাসপাতাল পৌঁছানোর আগেই অনেকে মারা যান। এই প্রস্তাবনায় একটি আধুনিক জরুরি সেবা ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। অ্যাম্বুলেন্সে প্রশিক্ষিত প্যারামেডিক থাকবে, যাতে হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই প্রাথমিক চিকিৎসা নিশ্চিত করা যায়। শুধু রোগী পরিবহনের পরিবর্তে, অ্যাম্বুলেন্সেই জীবনরক্ষাকারী চিকিৎসা শুরু হবে, যা মৃত্যুহার কমাতে সাহায্য করবে।

২. একটি কার্যকর রেফারেল সিস্টেম চালু করা : বাংলাদেশের বড় হাসপাতালগুলো রোগীর অতিরিক্ত চাপে বিপর্যস্ত কারণ অনেক রোগী উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের হাসপাতাল বাদ দিয়ে সরাসরি ঢাকায় চলে আসেন। এর ফলে যারা সত্যিকারের জটিল রোগী, তারা প্রয়োজনীয় সময়ে চিকিৎসা পান না। এই প্রস্তাবনায় একটি কার্যকর রেফারেল সিস্টেম চালুর সুপারিশ করা হয়েছে। যাতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক হাসপাতালগুলোকে শক্তিশালী করা হয় এবং রোগীদের সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় চিকিৎসা নিশ্চিত করা যায়।

৩. স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য উন্নত কর্মপরিবেশ ও ন্যায্য পারিশ্রমিক : বাংলাদেশের চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা দীর্ঘ সময় কাজ করেন কিন্তু তাদের বেতন কম, পদোন্নতির সুযোগ অপ্রতুল এবং অনেক সময় সহিংসতার শিকার হন। এই প্রস্তাবনায় ন্যায্য বেতন, কর্মজীবনের অগ্রগতি এবং নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় চিকিৎসক ও নার্সদের কাজ করতে উৎসাহিত করতে অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা ও আর্থিক প্রণোদনার ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে। নারীদের জন্য কাজের সুবিধাজনক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হাসপাতালে ডে-কেয়ার সুবিধাসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নীতির সুপারিশ করা হয়েছে।

৪. সারা দেশে ডিজিটাল স্বাস্থ্যব্যবস্থা (EHR) চালু করা : বর্তমানে একজন রোগী যখন এক হাসপাতাল থেকে আরেকটিতে যান, তখন তার আগের চিকিৎসার তথ্য নতুন চিকিৎসক জানেন না। ফলে বারবার পরীক্ষা করতে হয়, সময় নষ্ট হয়, আর চিকিৎসায় ভুলের ঝুঁকি বাড়ে। এ সমস্যা দূর করতে একটি জাতীয় ইলেকট্রনিক স্বাস্থ্য রেকর্ড (EHR) ব্যবস্থা চালু করার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রতিটি রোগীর একটি ডিজিটাল স্বাস্থ্য পরিচয় থাকবে, যা দেশের সব হাসপাতালে ব্যবহার করা যাবে, যা চিকিৎসার গতি বাড়াবে ও খরচ কমাবে। পাশাপাশি চিকিৎসা সংক্রান্ত কোনো অনিয়ম ঘটলে তা দ্রুত চিহ্নিত ও সংশোধন করা সম্ভব হবে।

৫. চিকিৎসার জন্য প্রমাণভিত্তিক জাতীয় গাইডলাইন : বাংলাদেশে চিকিৎসা পদ্ধতিতে কোনো নির্দিষ্ট মানদণ্ড নেই, ফলে একজন রোগী একই রোগের জন্য দুই জায়গায় দুই ধরনের চিকিৎসা পান। এই সমস্যার সমাধানে একটি জাতীয় চিকিৎসা গাইডলাইন চালু করা, যাতে দেশের সব চিকিৎসক একটি নির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করেন। চিকিৎসক ও নার্সদের জন্য এই গাইডলাইন অনুযায়ী প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা হবে।

৬. একটি জাতীয় বায়ো ব্যাংক স্থাপন : বাংলাদেশে গবেষণার সুযোগ সীমিত, যার ফলে নতুন ওষুধ ও উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতির উন্নয়ন সম্ভব হয় না। একটি জাতীয় বায়ো ব্যাংক স্থাপন হলে ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, হৃদ্‌রোগ ও সংক্রামক রোগের গবেষণা সহজ হবে, যা ভবিষ্যতে আরও উন্নত চিকিৎসা নিয়ে আসবে। এতে বাংলাদেশ বিদেশের ওপর নির্ভর না করে নিজের চিকিৎসা গবেষণা এগিয়ে নিতে পারবে।

৭. সরকারি উদ্যোগে নির্ভরযোগ্য স্বাস্থ্য তথ্য প্ল্যাটফর্ম : অসুস্থ হলে অনেকেই গুগল বা সামাজিক মাধ্যমে চিকিৎসা পরামর্শ খোঁজেন, যেখানে ভুয়া তথ্যের ছড়াছড়ি। এর ফলে অনেকে সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা পান না। এ সমস্যা সমাধানে একটি সরকারি উদ্যোগে পরিচালিত, নির্ভরযোগ্য ডিজিটাল স্বাস্থ্য প্ল্যাটফর্ম চালু করতে সুপারিশ করা হয়েছে। এখানে সহজ ভাষায় বিজ্ঞানভিত্তিক স্বাস্থ্য তথ্য ও চিকিৎসা পরামর্শ দেওয়া হবে। যাতে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারেন কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া প্রয়োজন এবং কোন চিকিৎসা বিজ্ঞানসম্মত ও নিরাপদ। এই প্ল্যাটফর্মটি সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গেও সংযুক্ত থাকবে যাতে রোগীরা সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় চিকিৎসা নিতে পারেন।