‘সলপের ঘোল’ যাচ্ছে সারাদেশে, দিনে বিক্রি ৩৫ মণ

লেখক:
প্রকাশ: ২ years ago

প্রতিদিন ভোরে গ্রামের খামারিদের কাছ থেকে গরুর দুধ সংগ্রহ করেন ঘোল ব্যবসায়ীরা। পরে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা জ্বাল দেওয়া শেষে সারা রাত রেখে দেওয়া দুধ একটি পাত্রে। পরে জমে থাকা দুধের সঙ্গে চিনি ও অন্য উপকরণ মিশিয়ে তৈরি করা হয় সুস্বাদু ঘোল। সকালে প্লাস্টিকের বোতল, বড় ক্যান ও প্লাস্টিকের ড্রামে দেশের বিভিন্ন স্থানের ক্রেতাদের জন্য পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে সিরাজগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী সলপের ঘোল।

রমজান মাস শুরু হওয়ার পর থেকেই ঐতিহ্যবাহী সলপের ঘোলের দোকানগুলোতে বেড়েছে বেচাবিক্রি। চাহিদাও বেড়েছে কয়েকগুণ।

 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রমজান উপলক্ষে জেলার উল্লাপাড়ার সলপ স্টেশনে প্রতিদিন ঘোল বিক্রি হচ্ছে ৩০/৩৫ মণ। প্রতি লিটার ঘোল ৭০ থেকে ৮০ টাকা এবং মাঠা বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ১০০ টাকায়। সুস্বাদু পানীয় ঘোল জেলার ৯টি উপজেলার চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছে সারাদেশে। শুধু চলনবিল ও যমুনা নদী বেষ্টিত এই জনপদে নয়, দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে আছে সলপের ঘোলের সুনাম।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, সলপের ঘোল তৈরির পেছনে আছে ১০০ বছরের ঐতিহ্য। রমজানের সঙ্গে গরম পড়েছে। তাই এই ঘোলের চাহিদা বাড়ায় দিনরাত কাজ করে চলেছেন কর্মীরা। বিভিন্ন এলাকার পাইকারি ও খুচরা ক্রেতারা এই ঘোল কিনতে ভিড় করছেন এখানে।

রোববার (২ এপ্রিল) সকালে সলপ রেলস্টেশন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, স্টেশনের পাশে ঘোলের দোকানগুলোতে বেচাবিক্রি চলছে। দোকানের সামনে মাটির পাত্রে পসরা সাজিয়ে চলছে বিক্রি। দোকানের পেছনে কর্মীরা ঘোল তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। দোকানের সামনে স্টিলের হাড়ি থেকে ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী ঘোল ও মাঠা বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। সেই সঙ্গে বিভিন্ন উপজেলার পাইকাররা এখান থেকে ঘোল নিয়ে বিভিন্ন হাট-বাজারে বিক্রি করেন। অনেকে আবার পরিবার এবং আত্মীয়-স্বজনদের জন্য ঘোল ও মাঠা কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।

বিক্রেতারা বলছেন, প্রতিদিন এই এলাকায় ৩০ থেকে ৩৫ মণ ঘোল ও মাঠা বিক্রি হয়। বর্তমানে প্রতি লিটার ঘোল ৭০/৮০ টাকা, মাঠা ৯০/১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

 

স্থানীয় প্রবীণেরা বলেন, উল্লাপাড়ার সলপ রেলওয়ে ষ্টেশনের পাশে বাংলা ১৩২৯ সালের (ইংরেজি ১৯২২) ৭ বৈশাখ এই বিশেষ ঘোল তৈরির সূচনা করেন বেতবাড়ি গ্রামের সাদেক আলী খান। সলপের ওই সময়কার প্রভাবশালী জমিদাররা এই ঘোল তৈরিতে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। সাদেক আলী খানের নাতি আব্দুল মালেক তার ছোট ভাই আব্দুল খালেককে সঙ্গে নিয়ে পূর্বসুরিদের হাত ধরে নেমেছেন ঘোলের ব্যবসায়। ধরে রেখেছেন প্রাচীন ঐতিহ্য। রমজান মাসে এই ঘোলের চাহিদা প্রতি বছর বেড়ে যায় দ্বিগুণ।

সলপ ষ্টেশনে ঘোলের দোকানে গেলে প্রয়াত সাদেক আলী খানের কাহিনী তুলে ধরেন ঘোল ব্যাবসায়ী আব্দুল মালেক। তিনি বলেন, সলপের জমিদারদের অনুপ্রেরণা ও সহায়তায় আমার দাদা বাংলা ১৩২৯ সালে সলপ ষ্টেশনের পাশে গড়ে তোলেন ঘোল তৈরির কারখানা। এর আগে আমার দাদা রাজশাহীতে একটি মিষ্টির দোকানের কারিগরের কাছে ঘোল তৈরির কাজ শেখেন। পরে সলপে ফিরে এসে ৭ বৈশাখ শুরু করেন ঘোল তৈরি। শুরুতে ৮ থেকে ১০ মণ করে ঘোল উৎপাদন করা হতো। প্রতিষ্ঠালগ্নে আমাদের উৎপাদিত ঘোলের বেশিরভাগ অংশ কিনে নিতেন সলপ জমিদার পরিবারের লোকজন। জমিদাররা সে সময় এই ঘোল ট্রেনযোগে কলকাতায় তাদের স্বজনদের কাছে নিয়মিত পাঠাতেন। সেই থেকেই সলপের ঘোলের সুনাম রয়েছে দেশ ও বিদেশে।

 

ঘোল উৎপাদনকারী আব্দুল খালেক বলেন, রমজান মাসে সলপের ঘোলের চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। রমজানের আগে ঘোলের চাহিদা ছিল প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ মণ। রোজায় এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৩৫ মণ। ভরা ব্যবসার সময়ে
ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী ঘোল উৎপাদন করতে পারছি না। এলাকার মানুষকে ফেরাতে না পারলেও দূরদূরান্ত থেকে ঘোল কিনতে আসা অনেক ছোট ব্যবসায়ীকে প্রতিদিন ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে। দুধের সংকট রয়েছে এলাকায়। চাহিদা পূরণ করতে পারলে উৎপাদন আর বিক্রির অঙ্কটা আরও বড় হতো। সঙ্গে লাভের অঙ্কটাও।

 

সলপের ঘোলের সুনাম শুনে পাবনার বেড়া উপজেলা থেকে বন্ধুদের নিয়ে সলপে এসেছেন আশরাফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘এই ঘোলের একটা সুনাম আছে। গরমে ঘোলের স্বাদ নিয়ে একটু প্রশান্তির জন্য সলপে আসা। এই ঘোল আসলেই অনেক সুস্বাদু। আমি আমার পরিবারের জন্য ১০ লিটার ঘোল ও ১০ লিটার মাঠা কিনে নিয়ে যাচ্ছি।’

সিরাজগঞ্জ শহর থেকে ঘোল কিনতে আসা মৌসুমী ব্যবসায়ী জিয়া শেখ বলেন, পুরো রমজান মাসে এখান থেকে ঘোল ও মাঠা কিনে নিয়ে এলাকায় বিক্রি করি। প্রতিদিন ৫ থেকে ৬ মণ ঘোল এলাকায় বিক্রির জন্য নিয়ে যায়। অন্যান্য জায়গার ঘোলের চেয়ে এখানকার ঘোলের দাম প্রতি কেজিতে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেশি। দাম বেশি হলেও এই ঘোলের কদর সবচেয়ে বেশি।‘

উল্লাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. উজ্জ্বল হোসেন জানান, সলপের ঘোলের জনপ্রিয় বেশি। রমজান মাসে এখানকার ঘোলের চাহিদা বেড়ে যায় কয়েকগুন। দূরদূরান্ত থেকে পাইকার ও খুচরা ক্রেতারা আসেন ঘোল ও মাঠা কিনতে। এখানে যাতে অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটে এবং ঘোলের গুণগতমান যেন ঠিক থাকে সেজন্য উপজেলা প্রশাসন থেকে কড়া নজরদারি করা হচ্ছে।