বনলতা এক্সপ্রেস ট্রেনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদকে উন্নয়ন-অগ্রগতির অন্তরায় এবং একটি বৈশ্বিক সমস্যা আখ্যয়িত করে এর বিরুদ্ধে সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহবান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘কে কোথায় সন্ত্রাসী-জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে লিপ্ত সে ব্যাপারে শুধু গোয়েন্দা সংস্থাই নয়, আমাদের দেশবাসীকেও সতর্ক থাকতে হবে এবং এদের খুঁজে বের করে সঙ্গে সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাকে জানাতে হবে। কারণ, আমরা দেশে শান্তি চাই। শান্তিই দিতে পারে উন্নতি। শান্তিপূর্ণ পরিবেশ হলেই দেশ এগিয়ে যাবে।’
আওয়ামী লীগের সভাপতি মণ্ডলীর জ্যেষ্ঠ সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম এমপির নাতি শিশু জায়ান চৌধুরীর কলম্বোয় বোমা হামলায় মৃত্যুর প্রসঙ্গ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কয়েকদিন আগে ২১ তারিখে শ্রীলংকায় যে ঘটনা ঘটলো তাতে আমরা বাংলাদেশের কয়েকজনকে হারিয়েছি। সবথেকে দুর্ভাগ্য অনেকগুলো শিশু সেখানে মারা যায়। যেখানে আমাদের বাংলাদেশের শিশু জায়ানকে হারাতে হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশেও এই ধরনের ঘটনা ঘটানোর অনেক চেষ্টা চলছে। তবে, আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করে যাচ্ছে।’
এ সময় ১৫ আগস্টের কালরাতের কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সে সময় বিদেশে থাকায় আমরা দুবোন প্রাণে বেঁচে গেলেও সেদিন বঙ্গবন্ধু পরিবারের আর কেউ বাঁচেনি। শেখ ফজলুল হক মনির ছোট ভাই শেখ ফজলুল করিম সেলিমের মেয়ের প্রথম সন্তান এই জায়ান। তাকে এভাবে আজকে জীবন দিতে হলো। আমরা চাই না এ ধরনের কোন শিশুর মৃত্যু।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজ যেহেতু ৮ বছরের শিশু জায়ান চৌধুরীকে আমরা হারিয়েছি। আমি জানি না যারা এ ধরনের হত্যাকাণ্ড চালায় তারা কি পায়, কি লাভ তাদের হয়? মানুষের ঘৃণা এবং অভিশাপ ছাড়া আর কিছু তারা পায় না।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘যারা ইসলাম ধর্মের নাম নিয়ে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ চালায় তারা এই পবিত্র ধর্মকে কলুষিত করছে। বিশ্বব্যাপী এই পবিত্র ধর্মের বদনাম করছে। তারা আসলে ইসলাম ধর্মের প্রচণ্ড ক্ষতি করে দিচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘যে ধর্ম সবথেকে মানবতার ধর্ম, সবথেকে শান্তির ধর্ম- সেই ধর্মের নামে তারা জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করে। কাজেই এ ধরনের কাজে যারা সম্পৃক্ত-তাদেরকে বিরত থাকতে হবে। সে কারণে আমি সব অভিভাবক, শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি, বাংলাদেশের জনগণ এবং মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন বা ধর্মীয় শিক্ষাগুরু এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বী যারা প্রত্যেককে আমি বলবো, যার যার আওতায় যে সমস্ত শিশু, কিশোর, যুবক-যারা রয়েছেন বা ছাত্ররা যারা রয়েছেন বা শিক্ষকরা রয়েছেন বা সাধারণ মানুষের মধ্যে যদি এ ধরনের একটা প্রবণতা দেখা দেয় সম্মিলিতভাবে এর বিরুদ্ধে সবাইকে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আমি আহবান জানাচ্ছি।’
উল্লেখ্য, ‘গত রবিবার শ্রীলঙ্কায় গির্জা, অভিজাত হোটেল ও কলম্বোর পার্শ্ববর্তী এলাকায় ভয়াবহ সিরিজ বোমা হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। হামলায় এখন পর্যন্ত ৩৫৯ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন পাঁচ শতাধিক।’
প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক এসময় গণভবন প্রান্তের মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. নজিবুর রহমান ভিডিও কনফারেন্সটি সঞ্চালনা করেন। অনুষ্ঠানে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোফাজ্জ্বল হোসেন নতুন চালুকৃত বনলতা এক্সপ্রেসসহ সমগ্র রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অগ্রগতির ওপর একটি পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করেন।
প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে জুম্মার খুৎবায় সন্ত্রাস এবং জঙ্গিবাদের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে তরুণ এবং যুব সমাজকে এ সম্পর্কে সতর্ক থাকার জন্য দিক নির্দেশনা প্রদানের জন্য মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের প্রতি আহবান জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আগামী শুক্রবার প্রতিটি মসজিদে শ্রীলংকার এই বোমা হামলা এবং জায়ান চৌধুরীর নিহত হওয়ার ঘটনায় এবং এর আগে নিউজিল্যান্ডের দু’টি মসজিদে গুলি চালিয়ে মুসলমানদের হত্যার ঘটনায় আপনারা দোয়া কামনা করবেন। ইমাম-মুয়াজ্জিন যারা আছেন তাদের কাছে অনুরোধ থাকবে, আপনারা দয়া করে জঙ্গিবাদ যে ইসলাম ধর্মের জন্য ক্ষতিকারক তা জনগণকে বোঝাবেন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যেখানে আমাদের নবী করিম (সা:) সবসময় শান্তির কথা বলে গেছেন, আর আল্লাহ রাব্বুল আলামিনও শেষ বিচারের দায়িত্ব মানুষকে দেন নাই। সেটি আল্লাহর হাতে। আমরা যারা কোরআন শরিফ পড়ি, যেখানে বারবার প্রায় প্রতিটি সুরাতেই আমরা তা পাই যে, বিচার করবেন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। তাহলে এই ধর্মের নামে মানুষ খুন করা কেন? যারা বিপথে চলে গেছে এর থেকে তারা যেন বিরত হয়।’
তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, সারাদেশে প্রত্যেক মসজিদে জুম্মার নামাজের খুৎবায় জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এবং ইসলাম শান্তির ধর্ম সে কথাটা ভালভাবে মানুষের কাছে তুলে ধরা হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াত জোট ২০০১ সালে ক্ষমতায় এলে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। ৫শ জায়গায় একই দিনে বোমা হামলা থেকে শুরু করে গ্রেনেড হামলা, মানুষ খুন করা, আমাদের নেতা-কর্মীদের ওপর অকথ্য অত্যাচার-নির্যাতন, জেল, জুলুম, অত্যাচার ছাড়া আর কিছু তারা করেনি।’
তিনি বলেন, ‘ঐ রাজশাহী বিভাগে বাংলাভাই এবং জঙ্গিবাদের আখড়া ছিল এবং সব থেকে দুর্ভাগ্য তখনকার বিএনপি-জামায়াত সরকার এদের মদদ দিত। প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে নিয়ে তারা পুলিশের পাহারায় মিছিল করতো। এই দেশকে তারা সন্ত্রাস এবং জঙ্গিবাদের দেশে পরিণত করেছিল। যার প্রভাব এখনও আমরা দেখি।’
তিনি এ সময় বিএনপি-জামায়াতের অন্দোলনের নামে আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে হত্যারও কঠোর সমালোচনা করে বলেন, ‘আমাদের দুর্ভাগ্য যে, আমরা দেখেছি অগ্নিসন্ত্রাস, এই বিএনপি-জামায়াত আন্দোলনের নামে আগুন দিয়ে জীবন্ত মানুষ পুড়িয়েছে। আমরা রেলের নতুন নতুন বগি কিনেছি আর তারা সেগুলো আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। বিআরটিসি বাস কিনেছি সেগুলো পুড়িয়ে দিয়েছে। তাছাড়া প্রাইভেট গাড়ি, বাস, ট্রাক, লঞ্চ এমন কিছু নেই যা তারা অগ্নি সন্ত্রাসের কবলে ধ্বংস না হয়েছে।’
সে সময় সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন হয়েছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘স্বামীর চোখের সামনে স্ত্রী, স্ত্রীর চোখের সামনে সন্তান ও স্বামী, বাবা-মায়ের চোখের সামনে সন্তান এমমনটি সন্ত্রানের চোখের সামনে মা-বাবাকে পুড়ে যেতে তারা দেখেছে। কিন্তু আমরা চাই না এধরনের ঘটনা বাংলাদেশে ঘটুক।’
প্রধানমন্ত্রী এ সময় তার সরকার দেশের সর্বক্ষেত্রে উন্নয়ন করে যাচ্ছে উল্লেখ করে এই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য দেশে একটি শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন এবং সেদিকে লক্ষ্য রেখেই তার সরকার কাজ করে যাচ্ছে বলেও জানান।
তিনি বলেন, ‘স্বল্প খরচে আরামদায়ক ভ্রমন একমাত্র রেলই দিতে পারে।’ বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসক্রিপশনে রেল সম্পূর্ণ রূপে বন্ধ করে দেওয়ার পথেই বিএনপি যাচ্ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অথচ প্রায় ৫৪ হাজারের কিছু বেশি বর্গমাইলের এই বাংলাদেশের স্বল্প আয়ের মানুষের দ্রুত যোগাযোগের জন্য রেল একটি অবিকল্প মাধ্যম।
তার সরকার ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর এই জনপদে বন্ধ হয়ে যাওয়া রেল যোগাযোগ পুনরায় চালু এবং নতুন নতুন রেল সংযোগ এবং রেলপথ গড়ে তুলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের আপত্তি সত্ত্বেও তিনি বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুতে রেল সংযোগের ব্যবস্থা করেছিলেন। আর বিশ্ব ব্যাংক এখন যমুনা নদীর ওপর পৃথক একটি রেল সেতু নির্মাণেরও প্রস্তাব দিয়েছে। এতদিন পড়ে তারা বুঝলো এটার প্রয়োজন যে কতবেশি এবং এটা কত যে লাভজনক।’
তিনি আরও বলেন, ‘দেশটা আমাদের। কাজেই আমরা যতটা দেশের ভাল বুঝবো বাইরে থেকে হঠাৎ কেউ এসে সেটা বুঝবে না। এটাই হলো বাস্তবতা।’