‘এই রূপালি গিটার ফেলে একদিন চলে যাবো দূরে বহুদূরে’ নিজের কণ্ঠের গাওয়া এ গানের কথাগুলোই সত্যি হলো বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতের কিংবদন্তি গিটার বাদক ও সঙ্গীতশিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর বেলায়। চট্টগ্রামে কোনও মঞ্চে গান করতে গেলেই মায়ের কবরে ছুটে যেতেন তিনি। এবারও ফিরেছেন মায়ের কাছে। তবে নিথর দেহে। মায়ের কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন সঙ্গীত জগতের এই নক্ষত্র।
চট্টগ্রামে চৈতন্য গলি কবরস্থানে মায়ের কবরের পাশেই হলো এ শিল্পীর শেষ ঠিকানা। শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটার দিকে সমাহিত করা হয় আইয়ুব বাচ্চুর মরদেহ।
এর আগে দুপুর দুইটার দিকে আইয়ুব বাচ্চুর মরদেহ নেওয়া হয় নানার বাড়ি পূর্ব মাদারবাড়ি থেকে নগরের জমিয়তুল ফালাহ মসজিদ প্রাঙ্গনে। সেখানে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে প্রিয় শিল্পীকে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাখা হয়। এসময় অশ্রুজলে ভাসেন অনেকে।
আইয়ুব বাচ্চুর মরদেহে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন, আইয়ুব বাচ্চুর বাবা মো, ইসহাক, ছোট ভাই ইরফান চৌধুরী, ছেলে তাজওয়ার আহনাফ আইয়ুব, নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক মো. শাহ আলম, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার আবদুল মান্নান, নগর পুলিশের কমিশনার মাহাবুবর রহমান, মহানগর বিএনপি’র সভাপতি ডা. শাহাদাত হোসেন, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান, মহানগর যুবলীগের আহবায়ক মহিউদ্দিন বাচ্চু, চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমি, সোলস, রিদম, স্পার্ক, চিটাগং মিউজিক্যাল ব্যান্ড অ্যাসোসিয়েশন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ডসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের লোকজন।
এ সময় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, ‘শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু শুধু চট্টগ্রামের সম্পদ নয়, সারা বাংলাদেশের অমূল্য সম্পদ। এ সম্পদ আমরা হারিয়েছি। তাকে একনজর দেখতে নারী-পুরুষ, শিশু থেকে বৃদ্ধ মানুষের যে ঢল নেমেছে তাতে বুঝা যায় তিনি বাংলাদেশে সংগীতাঙ্গনে কতটা জনপ্রিয় ছিলেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘নগরের গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থানে আইয়ুব বাচ্চুর স্মৃতি স্মরণে আবক্ষ ভাস্কর্য তৈরি করে তা বসানো হবে। এ বিষয়ে করপোরেশনের সাধারণ সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। দ্রুত সময়ের মধ্যে তা বাস্তবায়ন করা হবে।’
শনিবার সকাল ১০টা ৫৫ মিনিটে বেসরকারি একটি বিমানে আইয়ুব বাচ্চুর মরদেহ চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছালে তা গ্রহণ করেন চট্টগ্রাম সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। এরপর কফিনে বন্দি শিল্পীর নিথর দেহ নেওয়া হয় নগরের সদরঘাট থানার পূর্ব মাদারবাড়ি তার নানার বাড়িতে। এখানেই শৈশব কৈশোর কেটেছে কিংবদন্তি এ শিল্পীর। নানার বাড়িতে কিছুক্ষণ রাখার পর শেষবারের মতো দেখতে আসা লোকজনের জন্য পূর্ব মাদারবাড়ির বালুর মাঠে রাখা হয় শিল্পীর মরদেহ।
এ সময় শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর ছেলে তাজওয়ার আহনাফ আইয়ুব বলেন, ‘আমার বাবা আপনাদের ভালোবাসতেন। বাবা মনের অজান্তে যদি কোন দোষ করে থাকেন আপনারা ক্ষমা করে দিবেন। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যেন আমার বাবাকে বেহেশত নসিব করে এ জন্য আপনারা দোয়া করবেন।’
আইয়ুব বাচ্চুর প্রথম গিটার গুরু ব্যান্ড দল স্পাইডারের প্রতিষ্ঠাতা জ্যাকব ডায়াস স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘গিটারের প্রতি ছিল তার অন্যরকম মমতা। গিটার শেখার জন্য আমার বাসায় চলে আসতেন। তার এভাবে চলে যাওয়া কোনভাবে মেনে নিতে পারছি না। সর্বশেষ মৃত্যুর আগের দিনও তার সঙ্গে কথা হয়েছে। আমার শেষ কৃত্যে তার আসার কথা, সেখানে তার শেষ কৃত্যে এসে আমাকে স্মৃতিচারণ করতে হচ্ছে আমার জন্য এরচেয়ে দুর্ভাগ্য আর কি হতে পারে।’
শিল্পীকে এক নজর দেখতে আসা চট্টগ্রামের ব্যান্ডদল তীরন্দাজের আবু বকর শাহেদ শান বলেন, ‘এপার ও ওপার বাংলায় রক মিউজিক প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখে গেছেন বাচ্চু ভাই। আমাদের মতো শত শত তরুণ বাচ্চু ভাইয়ের গিটার বাজানো দেখে ব্যান্ড দলে এসেছেন। তরুণদের জন্য অনুপ্রেরণা ছিলেন বাচ্চু ভাই। অভিভাবকও ছিলেন। তরুণরা অভিভাবক হারিয়েছেন। বাংলাদেশের সঙ্গীতাঙ্গন একজন কিংবদন্তিকে হারিয়েছেন। এ শূন্যতা পূরণের নই।’
গত বৃহস্পতিবার সকালে না ফেরার দেশে চলে যান আইয়ুব বাচ্চু। শুক্রবার বাদ জুমা জাতীয় ঈদগাহে তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরে মরদেহ নেওয়া হয় তার গানের স্টুডিও মগবাজারে ‘এবি কিচেনে’। সেখানে তার দ্বিতীয় জানাজা হয়।
এরপর মরদেহ নেওয়া হয় চ্যানেল আই কার্যালয়ে। সেখানে তৃতীয় জানাজা হয়। এর আগে সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তার মরদেহ রাখা হয় সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য। সেখানে মন্ত্রী, আমলা, গানের মানুষ ও আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা শিল্পীকে শেষ শ্রদ্ধা জানান।