জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাঁচ খুনিকে ইতোমধ্যে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন জল্লাদ শাহজাহান। এবার বঙ্গবন্ধুর আরেক খুনি আবদুল মাজেদের ফাঁসি কার্যকর করলেন জল্লাদ শাহজাহান। তার নেতৃত্বে ছিলেন আরও কজন জল্লাদ। এই জল্লাদ শাহজাহান যুদ্ধাপরাধী বিএনপির সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, জামায়েতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকেও ফাঁসি দিয়েছেন। দীর্ঘ ৩৬ বছরের কারাবন্দি জীবনে এ পর্যন্ত প্রায় তিন ডজন ফাঁসি দিয়েছেন শাহজাহান।
জানা যায়, একজন সাধারণ কারাবন্দি থেকে এখন জল্লাদ হিসেবেই বেশি পরিচিত শাহজাহান। অথচ তিনি জল্লাদের খাতায় নাম লেখান কেবল কারামুক্তির সময় এগোনোর জন্য। প্রতিটি ফাঁসি দেয়ার সঙ্গে নিয়ম অনুসারে কমতে থাকে তার সাজার পরিমাণ। যদিও শাহজাহান জানেন না, কারাবন্দি জীবন থেকে মুক্তি পেয়ে পৃথিবীর মুক্ত আলো-বাতাস দেখতে পাবেন কি-না, তবু চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
শাহজাহান একসময় চাকরি করতেন সেনাবাহিনীতে। কিন্তু ভাগ্য তাকে টেনে নিয়ে গেছে অন্ধকার জগতে। এরপর থেকে জেলের সাথে নিজের জীবনকে জড়িয়ে নিয়েছেন। আটক হয়ে ৩৬ মামলায় ১৪৩ বছরের সাজাপ্রাপ্ত হন তিনি। সাজা কমার আশায় জল্লাদের খাতায় নাম লেখান শাজাহান। এরপর জল্লাদ হিসেবে এমন খ্যাতি কামিয়েছেন যে, দেশে তিনিই একমাত্র জল্লাদ যিনি একরাতেই দুই কারাগারে ৪ আসামিকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়েছেন।
যা ঘটেছিল শাহজাহানের জীবনে
পুরো নাম মো. শাহজাহান ভূঁইয়া। জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫০ সালের ২৬ মার্চ। জন্মস্থান নরসিংদীর পলাশ উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের ইছাখালী গ্রামে। বাবার নাম হাসান আলী ভূঁইয়া। মা সবমেহের। পড়াশোনা করেছেন এইচএসসি পর্যন্ত। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অবিবাহিত।
শৈশব থেকেই সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ড তাকে খুব আকর্ষণ করতো। বিশেষ করে তাদের শৃঙ্খলাবোধ তার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগতো। তাই মনে প্রাণে সবসময় স্বপ্ন দেখতেন সুযোগ পেলেই সেনাবাহিনীতে চাকরি করবেন। বাবার মাধ্যমে তিনি একবার খবর পান সেনাবাহিনীতে লোক নেয়া হচ্ছে। এরপর সেনাবাহিনীর চাকরির জন্য অংশগ্রহণ করলে তিনি টিকে যান। যথাসাধ্য তিন বছর সেনাবাহিনীতে থাকার পর বড় অফিসারদের ধমকের কারণে জিদ করে বাড়ি চলে আসেন। ১১ মাস কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকলে তার সেনাবাহিনীতে চাকরি করার স্বপ্নের কবর সেখানেই রচিত হয়।
স্বাধীনতাযুদ্ধের পর শাহজাহান নরসিংদী জেলা কমিউনিস্ট পার্টিতে সক্রিয় হন। তার পারফরম্যান্স দেখে কেন্দ্রে থেকে তাকে ডেকে পাঠানো হয়। শাহজাহানকে নরসিংদী জেলার কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতির দায়িত্ব দিতে চাইলে তিনি রাজি হয়ে যান। ১৯৭৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি জেলার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
এলাকায় শাহজাহান খুবই ভালো বলে পরিচিত ছিলেন। পারতপক্ষে কারও উপকার ছাড়া ক্ষতি করার চেষ্টা করতেন না। একবার তার গ্রামে নারীঘটিত একটি ঘটনা ঘটে। শাহজাহানের দুই বন্ধুসহ তার নামে অভিযোগ ওঠে। গ্রামে তাকে নিয়ে বিচারে বসা হয়। সেই বিচারে তাকে অপরাধী প্রমাণ করে সাজা দেয়া হয়। এরপর থেকেই তার ক্ষিপ্ততা শুরু। তিনি অপমান সহ্য করতে না পেরে সিদ্ধান্ত নেন অপরাধ জগতে প্রবেশ করে এই অপমানের চরম প্রতিশোধ নেবেন।
নারীঘটিত ওই ঘটনার পরে তিনি বাংলাদেশের একজন বহুল পরিচিত সন্ত্রাসীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান। তাছাড়া কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করার পর থেকে যে কোনো অপারেশনে তার চাহিদা দিনকে দিন বাড়তে থাকলো। তার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অপারেশন ছিল ১৯৭৯ সালে মাদারীপুর জেলায় এবং এটাই ছিল তার জীবনে সর্বশেষ অপারেশন। সেখানে অপারেশন শেষ করে মানিকগঞ্জ হয়ে ঢাকায় ফেরার চেষ্টা করেন। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশ জানতে পারে শাহজাহানের দল মানিকগঞ্জ হয়ে ঢাকায় যাবে।
মানিকগঞ্জে পুলিশ চেকপোস্ট বসালে শাহজাহান তার ওই এলাকার বাহিনীর মাধ্যমে তা জেনে যান। সব জেনেই ওই এলাকা দিয়ে ঢাকায় ফেরার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। রাতভর মানিকগঞ্জে পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধ করেন, কিন্তু পুলিশ তাকে ধরতে পারেনি। এরপর ঢাকায় পৌঁছে যখন নরসিংদীর উদ্দেশ্যে রওনা হন পথিমধ্যে পুলিশ তাকে আটক করে ফেলে। তার গতিময় জীবনের এখানেই সমাপ্তি এবং এরপর থেকে শুরু তার বন্দীজীবন।
৩৬টি মামলা ১৪৩ বছরের জেল
১৯৭৯ সালে আটক হওয়ার আগে ও পরে তার নামে সর্বমোট ৩৬টি মামলা হয়। এর মধ্যে একটি অস্ত্র মামলা, একটি ডাকাতি মামলা এবং অবশিষ্ট ৩৪টি হত্যা মামলা। বিচারকার্যে দেরি হওয়ার কারণে সাজা ছাড়াই তিনি ১৯৭৯ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত ১৭ বছর হাজতি হিসেবে কারাগারে থাকেন। ১৯৯৫ সালে তার সাজা হয় ১৪৩ বছর। পরে ১০০ বছর জেল মাফ করে তাকে ৪৩ বছরের জন্য কারাদণ্ড দেয়া হয়। শাহজাহানের জেল থেকে বের হওয়ার তারিখ তার কার্ডের ওপর লেখা, ‘ডেট অব রিলিজ ২০৩৫’।
যেভাবে জল্লাদ হলেন শাহজাহান
সাজা পাওয়ার পর শাহজাহান দেখলেন, জীবনের সোনালী সময়গুলো তাকে এখানেই কাটাতে হবে। তিনি ভাবলেন, জল্লাদ হিসেবে সময় দিলে তার সাজা কিছুদিনের জন্য হলেও কম হবে। তাই নিজেকে অন্যভাবে প্রস্তুত করার জন্য জেল সুপারের কাছে জল্লাদের খাতায় নাম লেখানোর আগ্রহ প্রকাশ করেন।
প্রথম ১৯৮৯ সালে তিনি সহযোগী জল্লাদ হিসেবে গফরগাঁওয়ের নূরুল ইসলামকে ফাঁসি দিয়ে তার জল্লাদ জীবনের সূচনা করেন। এটাই তার জীবনের প্রথম কারাগারে কাউকে ফাঁসি দেয়া। তার যোগ্যতা দেখে ৮ বছর পর ১৯৯৭ সালে কারা কর্তৃপক্ষ তাকে প্রধান জল্লাদের আসন দেয়। প্রধান জল্লাদ হওয়ার পর আলোচিত ডেইজি হত্যা মামলার আসামি হাসানকে প্রথম ফাঁসি দেন শাহজাহান।
একটি ফাঁসি দিতে প্রধান জল্লাদের সাথে ৬ জন সহযোগী লাগে এবং ফাঁসির রায় কার্যকর করলে প্রত্যেক জল্লাদের ২ মাস ৪ দিন করে কারাদণ্ড মওকুফ করা হয়। এছাড়া কারাগারে যারা জল্লাদ হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে থাকে, কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে শাহজাহান তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন।
শাহজাহানের হাতে কার্যকর হওয়া ফাঁসির মধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডিত আবদুল কাদের মোল্লা (২০১৩), শহীদ বুদ্ধিজীবী কন্যা শারমীন রীমা হত্যা মামলার আসামি খুকু-মনির (১৯৯৩), বহুল আলোচিত ডেইজি হত্যা মামলার আসামি হাসান (১৯৯৭), খুলনা জেলা কারাগারে এরশাদ শিকদার (২০০৪), রংপুর জেলা কারাগারে ইয়াসমিন হত্যা মামলার আসামি এএসআই মইনুল হক ও আবদুস সাত্তার (২০০৪), দিনাজপুরে ইয়াসমিন হত্যা মামলার আরেক আসামি পিকআপ ভ্যানচালক অমৃত লাল বর্মণ (২০০৪), কাশিমপুর ও ময়মনসিংহে জঙ্গি নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই, আতাউর রহমান সানি, আবদুল আউয়াল, খালেদ সাইফুল্লাহ ও ইফতেখার মামুন (২০০৭), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলায় মুত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ খুনি বজলুল হুদা, আর্টিলারি মুহিউদ্দিন, সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও ল্যান্সার মহিউদ্দিন আহমেদ (২০১০) উল্লেখযোগ্য।
শাহজাহান যখন কাউকে ফাঁসি দেন তখন পত্রপত্রিকায় তাকে নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়। তিনি যথাসম্ভব কারাগারে বসেই ওইসব পত্রিকাগুলোর কপি সংগ্রহ করেন।