পুরুষের চেয়ে নারী ভোটারের সংখ্যা বেশি হওয়ার পাশাপাশি এবারের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী অংশগ্রহণ না করায় বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে নারী ভোটার। কারণ ধারনা করা হচ্ছে বিএনপি সমর্থিত পুরুষ ভোটাররা এবার ভোট কেন্দ্রে আসবেন না।
সেই হিসেবে মেয়রসহ কাউন্সিলর প্রার্থীদের জয়লাভের জন্য নারী ভোটারের ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। আর এ কারণেই নারী ভোটারদের আকৃষ্ট করতে ইতোমধ্যে বরিশালের নির্বাচনী মাঠে ব্যাপক চমক সৃষ্টি করেছেন দুইজন মেয়র প্রার্থীর সহধর্মীনি। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে রয়েছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা মার্কার মেয়র প্রার্থী খোকন সেরনিয়াবাতের সহধর্মীনি লুনা আব্দুল্লাহ। তিনি গত এক মাস ধরে মহানগর মহিলা আওয়ামী লীগের কর্মীদের নিয়ে নগরীর ৩০টি ওয়ার্ডের ভোটারদের দ্বারে দ্বারে স্বামীর পক্ষে ভোট চেয়ে সাধারণ ভোটারদের মনজয় করে নিয়েছেন। ফলে লুনা আব্দুল্লাহকে ঘিরে নারী ভোটারদের মধ্যে এখন নৌকা মার্কার জয়জয়কার শুরু হয়েছে।
দেশের সবস্তরে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে জানিয়ে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক ও নির্বাচন বিশ্লেষক সোহেল রানা বলেন, বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নারী ভোটারের সংখ্যা বেশি। পাশাপাশি যেহেতু বরিশালে বিএনপির ভোটার বেশি, আর নির্বাচনে যখন বিএনপির প্রার্থী অংশগ্রহণ করেননি, সেক্ষেত্রে সহজেই বলা যায় ভোট কেন্দ্রে পুরুষ ভোটারের সংখ্যা কম হবে। সেদিক থেকে এবার নারী ভোটাররা ভোটের রাজনীতিতে এখানে প্রতিনিধি নির্বাচনে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন। স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দেওয়ার মাধ্যমে নারী ভোটাররা বরিশাল সিটি করপোরেশনে মেয়র ও কাউন্সিলর নির্বাচনে বিজয়ের ব্যাপারে বড়ধরনের ভূমিকা পালন করবেন।
সনাকের সাবেক জেলা সভাপতি প্রফেসর শাহ সাজেদা বলেন, শুধু মুখে বা সভা মঞ্চে নয়; আজ সময় এসেছে সমাজের সব শ্রেণি ও পেশার নারীকে একটি সত্যিকারের অন্তর্ভূক্তিমূলক কাঠামোয় আনবার। এ উদ্যোগটি আজ ভীষণ প্রয়োজনীয়। তিনি আরও বলেন, দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে পেছনে ফেলে টেকসই উন্নয়ন করা সম্ভব নয়। নির্বাচনের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা যারা পাবেন, তারা যত দ্রুত এ বাস্তবতাটি অনুধাবন করবেন ততই সবার জন্য মঙ্গল হবে।
নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ডের নারী ভোটারদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তারা প্রার্থীর গুরুত্ববোধের বিষয়টিকে মুখ্য হিসেবে দেখছেন। নগরীর রসুলপুর এলাকার বাসিন্দা মরিয়ম বেগম বলেন, ভোটের আগে আমাদের কদর বেশি থাকে কিন্তু ভোটের পর আমাদের আর কেউ খোঁজ রাখেনা। তাই যে খোঁজ রাখবে না তার পক্ষে যাবোতো নাই, প্রয়োজনে ভোটই দেবোনা। একই এলাকার বাসিন্দা গৃহিনী রুবিনা বেগমের দাবি, বিপদে-আপদে যে পাশে থাকবে তাকেই ভোট দিয়ে বিজয়ী করবো। তবে আমাদের এলাকার উন্নয়ন প্রয়াত মেয়র শওকত হোসেন হিরণই করে গেছেন। এরপর আরও কয়েকজন মেয়র থাকলেও কেউ আমাদের খোঁজ নেয়নি। তাই এখন কে আমাদের মেয়র হয়ে খোঁজ নেবেন, তাকেই আমরা ভোট দেবো। তিনি আরও বলেন, কারণে অকারণে যেসব প্রার্থী ফতোয়া জারি করবেন, যাদের ভয়ে ঘর থেকে বের হওয়া কিংবা প্রতিবাদ করা যাবেনা, যারা এলাকার উন্নয়ন করতে পারবেন না, সেরকম প্রার্থীদের আর এবার ভোট দিবোনা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখনও আনুষ্ঠানিক প্রচার-প্রচারণা শুরু না হলেও ভোটের মাঠে আলোচনায় রয়েছে যেসব দলীয় মেয়র প্রার্থী তারা ইতোমধ্যে ভোট চেয়ে কৌশলে নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন নগরজুড়ে। তবে বাস্তব চিত্র বলছে, প্রচারণায় পুরুষদের পাশাপাশি নারী ভোটারদের গুরুত্ব দিয়ে মাঠের কাজ এগিয়ে নিচ্ছেন মেয়র প্রার্থীদের পাশাপাশি তাদের সহধর্মীনিরা।
ইতোমধ্যে নারী ভোটারদের টার্গেট করে নির্বাচনী প্রচারণায় ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা মার্কার মেয়র প্রার্থী প্রধানমন্ত্রীর ফুফাত ভাই আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাতের স্ত্রী লুনা আব্দুল্লাহ এবং জাতীয় পার্টির প্রার্থী ইকবাল হোসেন তাপসের স্ত্রী ইসমত আরা ইকবাল। তারা নারী হওয়ায় সহজেই নারী ভোটারদের কাছে গিয়ে নিজেদের প্রার্থীর কথা তুলে ধরতে পারছেন। এরমধ্যে বরিশাল নগরীর মেয়ে হওয়ায় খুব সহজেই নারী ভোটারদের মনজয় করে নিয়েছেন নৌকার প্রার্থীর স্ত্রী লুনা আব্দুল্লাহ।
নারী ভোটারদের বিষয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী খোকন সেরনিয়াবাত বলেন, যেখানেই আমি যাচ্ছি, সেখানে মানুষ আমাকে ভালোভাবে গ্রহণ করছেন। আমি বিশ্বাস করি মানুষ আমাকে ভোট দেবেন। প্রধানমন্ত্রী আস্থার জায়গা থেকে দলীয় মনোনয়ন দিয়েছেন জানিয়ে খোকন সেরনিয়াবাত বলেন, আমাকে বিজয়ী করতে আমার স্ত্রীসহ দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করছেন। নারীদের সামগ্রিক উন্নয়নে কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, আগামী ১২ জুনের নির্বাচনে আমাকে মেয়র নির্বাচিত করা হলে আমি নারীদের জন্য বিশেষ করে তাদের সামাজিক নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিতের পাশাপাশি কর্মসংস্থানের ওপর জোরদার করবো। আর এক্ষেত্রে যেহেতু আমাদের রাজনৈতিক অভিভাবক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একজন নারী সেজন্য বরিশালের নারীদের উন্নয়নে তার সবধরনের সহযোগিতা পাবো।
নৌকার প্রার্থীর সহধর্মীনি লুনা আব্দুল্লাহ বলেন, প্রধানমন্ত্রী প্রথমবারের মতো বরিশালবাসীর ভাগোন্নয়নের জন্য আমার স্বামীর হাতে নৌকা তুলে দিয়েছেন। আমার স্বামীও চাচ্ছেন তার জীবনের বাকিটা সময় বরিশালবাসীর পাশে থাকতে। তাই নতুন প্রার্থী হিসেবে আমার স্বামীকে মেয়র নির্বাচিত করা হলে, আমি নগরবাসীকে কথা দিয়েছি ২৪ ঘন্টা তাদের যেকোন প্রয়োজনে আমার বাসার দরজা তাদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। তিনি আরও বলেন, আমি একজন নারী আমার শ্রদ্ধাভাজন আপা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও একজন নারী। তাই বরিশালের নারীদের ভাগোন্নয়নে যেকোন কাজ আমি সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনা করে আনতে পারবো ইনশআল্লাহ। যা অন্য কেউ পারবেনা।
অপরদিকে নারীদের জন্য নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়ার কথা জানিয়ে জাতীয় পার্টি মনোনীত মেয়র প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার ইকবাল হোসেন তাপস বলেন, বরিশালে পুরুষদের চেয়ে নারী ভোটারের সংখ্যা বেশি হওয়ায় তাদের গুরুত্বটা প্রার্থী হিসেবে আমাকে আগে উপলব্ধি করতে হবে। আমি বিজয়ী হলে শুধুমাত্র শিশু ও নারীদের জন্য বিশেষায়িত একটি হাসপাতাল গড়তে চাই। যেখানে চিকিৎসক থেকে সব জায়গাতে নারীদের কর্মসংস্থান হবে। লাঙলের প্রার্থী ইকবাল হোসেন তাপসের স্ত্রী ইসমত আরা ইকবাল বলেন, আমার স্বামীকে মেয়র নির্বাচিত করা হলে বরিশাল সিটিকে নারীবান্ধব নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে সবধরনের কাজ করা হবে।
উল্লেখ্য, ওই দুই মেয়র প্রার্থী ব্যতিত বরিশালে আরো চারজন মেয়র প্রার্থী রয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন, ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ মনোনীত হাতপাখার মেয়র প্রার্থী মুফতী সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করিম, জাকের পার্টি মনোনীত মিজানুর রহমান বাচ্চু, স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল আহসান রুপন ও আলী হোসেন।