মোঃ শাহাজাদা হিরা: গতকাল ২২ মে সকাল ১০ টায় জেলা প্রশাসন এর কার্যালয় জেল খালের অবৈধ স্থাপনা, আবর্জনা অপসারণপূর্বক জনসাধারণের ব্যবহার উপযোগী করার লক্ষ্যে প্রাক প্রস্তুতিমুলক সভার আয়োজন করা হয়। এসময় উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসক মোঃ হাবিবুর রহমান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রাজস্ব মোঃ আবুল কালাম তালুকদার, বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ওহেদুজ্জামান, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ইকবাল আকতার, প্রবীণ রাজনীতিবিদ হোসেন চৌধুরী নানাসহ বিভিন্ন স্তরের সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি গণ উপস্থিত ছিলেন। সভায় জেল খাল এর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে উন্মুক্ত আলোচনা করা হয়। আলোচনা শেষে কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যেমন: কিছু দিনের মধ্যে জেল খাল রক্ষায় প্রশাসনের সাথে কাজ করবে বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি সংস্থা সমুহ।জেল খাল এর জন্য বর্তমানে ৬ লক্ষ টাকা বরাদ্ধ এসেছে আরো কিছু টাকা আনুদান আসবে, যা জেল খাল এর অবকাঠামো উন্নয়নে কাজে লাগানো হবে। কিছু দিনের মধ্যে এই খালের খনন কাজ পুরোদমে শুরু করা হবে। এর ময়লা কাঁদা মাটি বরিশাল বোর্ড় সংলগ্ন হাইটেক পার্ক এর জমিতে ফেলা হবে। জেল খালে কোন প্রকার ময়লা ফেলা হলে ঐ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হবে। জেল খালের দুই পাশে ওয়ার্কওয়ে করা হবে। জেল খাল খননের সাথে সাথে দুই পাড়ে গাছ লাগানোর উদ্যোগ নেয়া হবে ইত্যাদি। জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান জানান, জেলখাল সহ ২২টি খালের উন্নয়নে যে অর্থ বরাদ্দ আসার কথা তা এখনো আসেনি। তবে এ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। যার অংশ হিসেবে আমাদের এই প্রস্তুতিমুলক সভা। আমরা কিছু দিনের মধ্যে জেল খাল নিয়ে দৃশ্য মান কাজ করবো। আমাদের এই কাজে সকলের সহযোগীতা কামনা করছি।
উল্লেখ বরিশালের প্রাণখ্যাত ঐতিহ্যবাহী জেল খালটি দখলদারদের কবল থেকে খালটি মুক্ত করতে ২০১৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সর্বকালের স্মতঃস্ফুর্ততার উদাহরন সৃষ্টি করে হাজার হাজার মানুষের স্বেচ্ছাশ্রমে ঐতিহ্যবাহি জেল খালটিতে পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালানো হয়।
অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন কর্মসূচীতে অংশ নেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এমপি, বরিশাল সদর আসনের সংসদ সদস্য জেবুন্নেছা আফরোজ, বরিশাল-৩ আসনের সংসদ সদস্য এ্যাড. শেখ মো: টিপু সুলতান, স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব আব্দুল মালেক, সিটি মেয়র আহসান হাবিব কামাল, বরিশাল জেলা প্রশাসক ড. গাজী মো: সাইফুজ্জামান, বরিশালের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আবুল কালাম আজাদ, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) কাজী হোসনেয়ারা।
এর সাথে হাজার হাজার নারী-পুরুষ, মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক, তরুন-তরুনী ও স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রী, স্কাউট, বিএনসিসি, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মীরা। এরপর থেকে শুধুই অপেক্ষা কবে আবার এ খালটি তার জৌবন ফিরে পাবে?
প্রায় দুই বছর পার হতে চললেও বরাদ্দ না পাওয়ায় খাল খনন কর্মসূচি বন্ধ রয়েছে।
ফলে ঐতিহ্যবাহী জেল খালসহ বরিশালের ২৩টি খাল পুনরায় দখল দূষণের আশংকা রয়েছে। অথচ তৎকালীন জেলা প্রশাসক ড. গাজী সাইফুজ্জামান ২৫ কোটি টাকার প্রকল্পের আবেদন করেছিলেন বলে জানা যায়। আবেদনের প্রেক্ষিতে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব আব্দুল মালেক জানিয়েছিলেন, জেল খাল উন্নয়নে ২৫ কোটি টাকার প্রকল্প শীঘ্রই পাস হবে।
তবে ওই প্রকল্প আজও আলোর মুখ দেখেনি। ধান-নদী-খাল এই তিনে বরিশাল, নদী ও খাল বরিশালের জিবন প্রবাহ। এই নদী ও খালের সমন্বয়ে নগরের সৌন্দর্য দেখে জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম বরিশালকে ‘প্রাচ্যের ভ্যানিস’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। নদী থেকে বড় ও ছোট ছোট খালের মাধ্যমে জেলার বিভিন্ন গ্রাম ও গঞ্জ সংযোজিত হয়েছে।
এক কথায় বরিশাল নদ-নদী, খাল-দোন দ্বারা জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে। এই খাল ও নদীতে নানাবিধ বজরা, কোষা ও নৌকায় যোগাযোগের মাধ্যমে বরিশালের মানুষ পন্য নিয়ে স্থানিয় হাট-বাজার, গ্রাম-গঞ্জে চলাচল করতো। বরিশাল নগরের যেসব খাল দিয়ে যাত্রী ও পন্য পরিবহন হতো এর বেশ কয়েকটি ঘাটের অস্তিত্ব এখনো রয়েছে। সূত্রমতে, ৭০ দশকেও বরিশাল নগরের অভ্যন্তর দিয়ে ২২টি খালের প্রবাহের অস্তিত্ব ছিল।
এ সকল খালের মাধ্যমে নগরের বিভিন্ন হাট বাজার পেরিয়ে পার্শ্ববর্তী কীর্তনখোলা, সন্ধ্যা নদী, বাহেরচরনদীর সাথে সংযোগ হয়ে জোয়ার ভাটা প্রবাহিত হতো। কীর্তনখোলা নদীর উৎস থেকে বরিশাল শহরে প্রধানত আমানতগঞ্জ খাল, জেলখাল, ভাটারখাল, চাঁদমারিখাল, সাগরদীখাল ও পুডিয়াখাল সহ ৬টি খাল উৎসারিত হয়েছে। এই খালের শাখা ও উৎসে সৃষ্ট ২২টি খালের মাধ্যমে নগরের অভ্যন্তর দিয়ে এঁকে বেকেঁ প্রবাহিত হয়েছে।
কীর্তনখোলা নদী থেকে সাগরদি খালের মাধ্যমে ভেদুরিয়া খাল, নাপিতখালী খাল, পুডিয়া খাল, টিয়াখালী খাল, জাগুয়া খাল ও হরিনাফুলিয়া খাল নগরের পশ্চিম ও উত্তর সিমানায় কালিজিরা সন্ধ্যা নদীর সাথে মিলে বানারিপাড়া ও উজিরপুরের সাথে নৌযোগাযোগ হতো।
কীর্তনখোলা নদী অপর একটি প্রবাহ জেলখালের সাথে লাকুটিয়া খাল মিরগঞ্জ হয়ে বাহেরচর নদীর মাধ্যমে বাবুগঞ্জ সাথে সংযোজিত হয়েছে। এর অপর একটি শাখা নবগ্রাম খাল, কাশিপুর খাল, বাগিয়ার খাল, কলাডেমা খাল, কড়াপুর খালের সাথে মিলে বিভিন্ন গ্রাম ও গঞ্জে মিলেছে।
কীর্তনখোলার অপর সংযোগ আমানতগঞ্জ খালের মাধ্যমে সাপানিয়া খাল, সোলনা খাল, লাকুটিয়া খালের মাধ্যমে নগরের অভ্যন্তর দিয়ে বাবুগঞ্জের বাহেরচর নদীর সাথে সংযোগ ছিল। এর মাধ্যমে দূরবর্তি মানুষের নগর ও গ্রামের যোগাযোগ হত। জানা যায়, স্বাধীনতা পর ১৯৮০ সাল পর্যন্ত এই খাল দিয়ে শহরের সাথে নৌপথে বাবুগঞ্জ, উজিরপুর, বানারিপাড়া ও গৌরনদী উপজেলার বিভিন্ন বন্দর ও গ্রামের সাথে নিবির যোগাযোগ ছিল। বিভিন্ন প্রকার নৌকা ও ছোট লঞ্চ মাধ্যমে পণ্য পরিবহণ ও মানুষের যাতায়াত ছিল। এই খালের পারে প্রায় ২২টি পাঁকা ঘাটলা ছিল যা থেকে এলাকার অধিকাংশ মানুষের গোসলসহ পরিবারের প্রয়োজনে পানি ব্যাবহার ও সংগ্রহ করতো।
এই খালে জোয়া-ভাটার পানি দিয়ে উভয় পারে বিভিন্ন কৃষিকাজে ব্যাবহার হত। নানা জাতের মাছ উৎপন্ন হতো এবং এই মাছ ধরে একশ্রেনীর মানুষ জীবন ধারণ করতো। এই খালের সাথে অসংখ্য কাচাঁ ড্রেন ছিল এ থেকে প্রবাহিত পানি ও মাছ পার্শ্ববতী পুকুরে গিয়ে পড়ত।জেলখালের উপর দিয়ে উভয় পার্শের মানুষ যোগাযোগের জন্য পোটরেড ব্রিজ, চকেরপোল, নাজিরেরপোল, জেলেবাড়ীপোল, মরকখোলার পোল, নতুল্লাবাদপোল ইত্যাদি রয়েছে। স্বাধীনতার পূর্ব এবং পরবর্তীতে এ খাল দিয়ে ছোট ছোট লঞ্চ, ট্রলার এবং গয়না নৌকা চলাচল করত।
নাজিরপুল থেকে যাত্রী এবং মালামাল নিয়ে লঞ্চ, ট্রলার ও গয়না নৌকাগুলো সকালে, দুপুরে এবং বিকেলে ছেড়ে যেত গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। একইভাবে যাত্রী ও মালামাল নিয়ে বানারীপাড়া, নাজিরপুর, উজিরপুর হয়ে বরিশাল আসত। বিপুল সংখ্যক যাত্রী চলাচল করতেন এই খাল দিয়ে। পরবর্তীতে কীর্তনখোলার পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় এবং জেল খালের উভয় পাড়ের সম্পত্তি বেদখল শুরু হলে খালের পানি প্রবাহ কমে যায়।
এ সুযোগে গ্রামের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত জেল খালটি অবৈধ দখলদারদের কবলে চলে যায় এবং এক পর্যায়ে খালটির অনেকাংশেই ভরাট হয়ে যায়। বর্তমানে নথুল¬াবাদ ব্রীজের পর খালটিতে আর পানি প্রবাহ থাকে না বললেই চলে। আমাবস্যা বা পূর্নিমায় কিছুটা জোয়ার ভাটা হলেও পানি প্রবাহ থাকে কীর্তনখোলা নদী থেকে নথুল¬াবাদ ব্রীজ পর্যন্ত।
দখলদারদের থাবায় মৃত প্রায় জনগুরুতপূর্ণ এ খালটি ২০১৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর হাজার হাজার মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে উদ্ধার অভিযান চালিয়েছিলো জেলা প্রশাসন। তখন জেলা প্রশাসনের এ পদক্ষেপ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে দেশের সর্বত্র ব্যাপক প্রশংসিত হয়। এছাড়া খালের উন্নয়নে ২৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন চাওয়া হয় স্থানীয় সরকার বিভাগে। তবে এখন পর্যন্ত ওই বরাদ্দ না পাওয়ায় খালের উন্নয়নকাজ দৃশ্যমান হচ্ছেনা।
এদিকে দীর্ঘ সময় পার হওয়ায় পুনরায় খালটি ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে। কোন কোন স্থানে ময়লা স্তুপে দেখে বোঝার উপায় নেই যে এটি একটি খাল। সচেতন নগরবাসীর দাবি খালটির উন্নয়নে সরকারি অর্থ বরাদ্দে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া হোক। নদী খাল বাঁচাও আন্দোলন কমিটির সদস্য সচিব কাজী এনায়েত হোসেন শিবলু বলেন, অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ায় খালের উন্নয়নমূলক কাজ হয়নি। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে আমরা বিষয়টি তুলে ধরেছি।
তিনি বলেন, আগামী সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আমরা এ বিষয়টি তুলে ধরবো। যদি কেউ দায়বদ্ধতা না নেয় তাহলে জনগণকে বলবো এ নেতৃত্ব আমরা চাই না।
বর্তমান সরকারের এ মেয়াদে খালের উন্নয়ন কাজ হবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ সময়ের মধ্যে দৃশ্যমান কোন উন্নয়ন সম্ভব নয়। তার সরকার কোন দায় নিবেন না। কেননা উন্নয়ন একটি বাণিজ্যিক কৌশল।