দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলার বিনোদনগর ইউনিয়নে রাঘোবেন্দ্রপুর গ্রামের ঘটনা। শত্রুর পরিবারের ছেলের সঙ্গে প্রেম করার অপরাধে দীর্ঘ আড়াই বছর ধরে মেয়েকে অন্ধকার ঘরে বন্দি করে রাখলেন মা। আড়াই বছর পর মেয়েটিকে বন্দি ঘর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। আলো-বাতাসহীন স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার ঘর থেকে স্নাতক পড়ুয়া মেয়েটিকে অসুস্থ অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
তালাবদ্ধ ঘরে মেধাবী শিক্ষার্থী দুই বছর অবরুদ্ধ থাকার পর স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় জ্ঞান ফিরিয়ে শিক্ষার্থী জানায়, আমি লেখাপড়া করে উন্নত জীবন গড়ে পেশায় শিক্ষকতাকেই বেছে নিতে চাই।
গতকাল শুক্রবার দুপুরে মেয়েটিকে দেখতে যান দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মশিউর রহমান। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, সভ্য সমাজে এমন ঘটনা অবাক করার মতো। সরকার নারী শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যাপক উদ্যেগ নিয়েছে। মেধাবী শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনের গতি সচল রাখতে তিনি সার্বিক সহায়তা করবেন।
স্থানীয়রা জানান, বাবা-মা ও দুই ভাই তিন বোন নিয়ে তাদের পরিবার। তাদের পরিবারের সঙ্গে বিরোধ আছে পাশের এমন এক পরিবারের ছেলের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে ছাত্রীর। বিষয়টি জেনে আড়াই বছর আগে ছাত্রীকে অন্ধকার ঘরে বন্দি করে রাখেন তার মা। ওই অন্ধকার ঘরেই আড়াই বছর কেটে যায় ছাত্রীর। বাড়িতে বিদ্যুৎ থাকলেও যে ঘরে ছাত্রীকে আটকে রাখা হয়েছিল, সে ঘরে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়নি। প্রতিবেশীদেরকে জানানো হয়েছিল মেয়েটি মানসিক রোগী তাই তাকে আটকে রাখা হয়েছে। চিকিৎসার জন্য প্রতিবেশীরা মেয়েটিকে সহযোগিতা করতে চাইলে মেয়ের মা বিষয়টি এড়িয়ে যান।
গত বৃহস্পতিবার নবাবগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা যায়, বন্দি থাকতে থাকতে ছাত্রীর মুখ ও পা বিবর্ণ হয়ে গেছে। হাতের আঙুলগুলো কুঁকড়ে গেছে। বসতে কিংবা দাঁড়াতে পারছেন না। কথা বলতে গেলে শরীর কাঁপে। শরীর থেকে বের হচ্ছিল দুর্গন্ধ। বার বার কথা বলার চেষ্টা করেও কথা বলতে পারেনি ছাত্রী। এদিকে হাসপাতালের চিকিৎসকরা মেয়েটির দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠা ও মানবিক দিক বিবেচনা করে তার আত্মীয়-স্বজন ছাড়া অন্য কাউকে দেখা করতে দিচ্ছেন না।
নবাবগঞ্জ উপজেলার স্বাস্থ্য ও প প কর্মকর্তা খায়রুল ইসলাম (তপন) বলেন, দীর্ঘদিন অপচিকিৎসায় ও ঘরবন্দী থাকায় ছাত্রীর রক্তশূন্যতা দেখা দিয়েছে এবং সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে চর্মরোগ, আর মুখে ফাঙ্গাস। ছাত্রীটি শারীরিক সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে।
ওই মেয়ের খালাতো বোন বলেন, এক বছর ধরে চেষ্টা করেও খালাতো বোনের সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। রংপুরের একটি স্কুলের মানবিক বিভাগ থেকে ২০১১ সালে এসএসসি ও নবাবগঞ্জের একটি কলেজ থেকে ২০১৩ সালে এইচএসসি পাস করে। লেখাপড়া শেষ করে তার শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন ছিল। এক ছেলের প্রেমে পড়ে জীবনটা শেষ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল তার।
ছাত্রীর বাবা-মায়ের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তারা কিছুই বলতে রাজি হননি। তবে ছাত্রীর মা বলেছেন, মেয়েটি অসুস্থ হওয়ায় সুস্থতার জন্য কবিরাজ ও স্বপ্নে দেখা এক ব্যক্তির পরামর্শে ঘরে আবদ্ধ করে রেখেছি।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মশিউর রহমান বলেন, আড়াই বছরের বেশি সময় আটকে রাখা হয়েছে খবর পেয়ে মাদরাসার শিক্ষক বাবাকে ডেকে পাঠাই। ছাত্রীর বাবা বলেছেন মা একক কর্তৃত্বে ছাত্রীকে আটক রেখেছেন। এরপর পুলিশ নিয়ে ছাত্রীকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করি। কোনো পরিবার তার সন্তানকে এভাবে বন্দি করে রেখে তিলে তিলে মৃত্যুর মুখে নিয়ে যেতে পারে, তা ভেবে অবাক হচ্ছি।
নবাবগঞ্জ থানা পুলিশের ওসি সুব্রত কুমার সরকার বলেন, মেয়েটি একটি ছেলেকে ভালোবাসত। ছেলেটির সঙ্গে বিয়ে না দেওয়ায় মেয়েটি অসুস্থ হয়ে পড়ে। এ কারণে পরিবারের লোকজন তাকে বাইরে যেতে দিত না, মেয়েটিও বাড়ি থেকে বের হতো না। একপর্যায়ে তাকে ঘরবন্দি করে রাখে তার পরিবার। এ বিষয়ে কেউ কোনো অভিযোগও করেনি আমাদের কাছে। এরপরও মেয়েটিকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। মেয়েটি সুস্থ হয়ে উঠলে প্রকৃত ঘটনা জানা যাবে।’’