পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘পুলিশকে আমি সব সময় আইনের রক্ষকের ভূমিকায় দেখতে চাই। দেশের প্রচলিত আইন, সততা ও নৈতিক মূল্যবোধই হবে পেশাগত দায়িত্ব পালনের পথনির্দেশক। আপনাদের মনে রাখতে হবে—সফলতার জন্য আপনারা যেমন পুরস্কৃত হবেন, তেমনি প্রতিটি কাজের জন্য জবাবদিহিও নিশ্চিত করতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী আজ সোমবার সকালে রাজারবাগে পুলিশ সপ্তাহ–২০১৮ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এসব কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যদের নিজেদের জনবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি আশা করি, প্রতিটি পুলিশ সদস্য অসহায় ও বিপন্ন মানুষের প্রতি দায়িত্ব পালন করবেন এবং সাহায্যের হাত বাড়াবেন। জাতির পিতা আপনাদের বলেছেন, আপনারা স্বাধীন দেশের পুলিশ। জনগণের প্রতি আপনাদের কর্তব্য অপরিসীম। তাই আপনাদের নিজেদের জনবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।’শেখ হাসিনা আশা প্রকাশ করে বলেন, ইতিমধ্যে পুলিশ সদর দপ্তরে ‘আইজিপি কমপ্লেইন সেল’ স্থাপন করা হয়েছে, যা পুলিশ সদস্যদের পেশাগত জবাবদিহি নিশ্চিত করতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
প্রধানমন্ত্রী পুলিশ সপ্তাহ–২০১৮ উপলক্ষে মনোজ্ঞ কুচকাওয়াজের সালাম গ্রহণ করেন এবং একটি খোলা জিপে করে প্যারেড পরিদর্শন করেন। সুপারিনটেনডেন্ট অব পুলিশ মহসিন হোসেন প্যারেড পরিচালনা করেন। ‘জঙ্গিবাদ মাদকের প্রতিকার, বাংলাদেশ পুলিশের অঙ্গীকার’ শীর্ষক প্রতিপাদ্য নিয়ে এবারের পুলিশ সপ্তাহ উদ্যাপিত হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী পুলিশ সদস্যদের মধ্যে ১৮২ জনকে চারটি ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশ পুলিশ পদক সাহসিকতা, রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক সাহসিকতা, বাংলাদেশ পুলিশ পদক সেবা ও রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক সেবা প্রদান করেন। এর মধ্যে মরণোত্তর বাংলাদেশ পুলিশ পদক সাহসিকতার জন্য সিলেটের আতিয়া মহলে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ, পরিদর্শক মো. মনিরুল ইসলাম ও পরিদর্শক কায়সরের পক্ষে তাঁদের স্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে এই পদক গ্রহণ করেন।
প্রধানমন্ত্রী সকালে রাজারবাগ প্যারেড গ্রাউন্ডে পৌঁছালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পুলিশের আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক ও স্বরাষ্ট্রসচিব মোস্তফা কামাল উদ্দিন তাঁকে স্বাগত জানান। মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, জাতীয় সংসদের সদস্য, সরকারের পদস্থ বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তা, কূটনীতিক ও আমন্ত্রিত অতিথিরা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
শেখ হাসিনা দৃপ্ত কণ্ঠে বলেন, ‘ইনশা আল্লাহ ২০২১ সালে আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করব ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়ে তুলে।’ তিনি সবাইকে দেশগড়ার কাজে আত্মনিবেদন করার আহ্বান জানান।
জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে সরকারের সাফল্য উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দক্ষতার সঙ্গে সরকার জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছে। তিনি এ সময় জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত পুলিশের ছয়জন, একজন র্যাব ও একজন ফায়ার সার্ভিস কর্মীর আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন। তিনি জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে পুলিশের সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত ‘কাউন্টার টেররিজম ইউনিট’-এর উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ দেশের শান্তি, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের জন্য বড় হুমকি। একজন সন্ত্রাসীর কোনো ধর্ম, বর্ণ বা গোত্র নেই। ধর্মের নামে যেকোনো সহিংস কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে তিনি জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে তাঁর সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির পুনরোল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘এ দেশের মাটিতে জঙ্গি, সন্ত্রাসী ও যুদ্ধাপরাধীদের স্থান হবে না। আমরা জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ বিস্তার রোধে তৃণমূল পর্যায়ে পরিবার, নারী, যুবসমাজ, গণমাধ্যম ও ধর্মীয় নেতাদের সম্পৃক্ত করে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলেতে চাই।’
স্থিতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দেশের উন্নয়নের পূর্বশর্ত উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী আইনশৃঙ্খলা খাতে বরাদ্দকৃত অর্থকে বিনিয়োগ হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, তাঁর সরকার একটি নিরাপদ শান্তিপূর্ণ দেশ গড়ার লক্ষ্যে বাংলাদেশ পুলিশের কৌশলগত পরিকল্পনা, অবকাঠামো ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করে কর্মক্ষেত্রে পুলিশের সার্বিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করার জন্য সরকার ব্যাপক কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে।
মিয়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনে প্রধানমন্ত্রী এ সময় পুলিশের দক্ষতার প্রশংসা করেন। পুলিশের দক্ষতা বৃদ্ধি ও উন্নয়নে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, বাংলাদেশ পুলিশের অনলাইন পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্ভিস, মোবাইল অ্যাপস-বিডি পুলিশ হেল্প লাইন, ই-ট্রাফিক প্রসিকিউশন অ্যান্ড ফাইন পেমেন্ট ইউনিট প্রবর্তনের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। তিনি এ সময় পুলিশের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় জাতীয় জরুরি সেবা ‘৯৯৯’-এর কার্যক্রম শুরু হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ, দমন ও অপরাধী শনাক্তকরণে ‘ক্রাইম ডেটা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (সিডিএমএস) এবং সিটিজেন ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (সিআইএমএস)’ সফটওয়্যারের মতো বাংলাদেশ পুলিশ নতুন নতুন প্রযুক্তিগত উদ্যোগ গ্রহণ করবে বলেও আশা প্রকাশ করেন। সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি খাতে সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য দেশে-বিদেশে পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণ প্রদান অব্যাহত থাকবে বলে জানান তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, পুলিশের আবাসন, রেশন, চিকিৎসাসুবিধা বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণ প্রদান এবং প্রয়োজনীয় যানবাহন ও অন্যান্য সরঞ্জাম অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সরবরাহের বিষয়টিও সরকারের বিবেচনায় রয়েছে। পুলিশের জন্য স্টাফ কলেজও আওয়ামী লীগ সরকারই করেছে। পুলিশের সার্জেন্ট পদে নারী সদস্য নিয়োগসহ সুযোগ-সুবিধা এবং পদমর্যাদা বৃদ্ধিতে তাঁর সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগও এ সময় প্রধানমন্ত্রী তুলে ধরেন।
বাংলাদেশ পুলিশ পদক ও রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদকে ভূষিতদের অভিনন্দন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এ পদক আপনাদের কাজের স্বীকৃতির পাশাপাশি আপনাদের ভবিষ্যতে আরও পেশাদারত্ব এবং আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করবে—এটাই আমার প্রত্যাশা।’