পাইপ দেশে আসার পর মান যাচাইয়ে বিদেশ সফর!

লেখক:
প্রকাশ: ৩ years ago

দেশে জ্বালানি নিরাপত্তার অগ্রগতির ক্ষেত্রে প্রায় তিন হাজার ১৭১ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়ন হচ্ছে ঢাকা-চট্টগ্রাম জ্বালানি পাইপলাইন প্রকল্প। দেশের অভ্যন্তরে তেল পরিবহনের জন্য এটিই হবে প্রথম পাইপলাইন। এ প্রকল্পেরই পাইপ দেখতে গত ১৪ এপ্রিল কানাডা যান বিপিসি চেয়ারম্যান। স্ত্রী-পুত্র ছাড়াও সফরসঙ্গী ছিলেন দুই যুগ্ম সচিব, পদ্মা অয়েল কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পাইপ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের দুই কর্ণধার। অথচ যে পাইপের মান যাচাইয়ে বিদেশ সফর তার বৃহদাংশ এরই মধ্যে দেশে পৌঁছেছে। আবার দুই যুগ্ম সচিবের একজন বিপিসি থেকে অন্য মন্ত্রণালয়ে চার মাস আগে বদলি হলেও তিনি ছিলেন সফরসঙ্গী হিসেবে।

তবে সফরের আদেশটি (জিও) হয়েছিল আরও চার মাস আগে। সরকারি আদেশ (জিও) মোতাবেক চার কর্মকর্তার কানাডা সফরের ব্যয়ভার পাইপ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বহন করলেও বিপিসি চেয়ারম্যানের স্ত্রী-পুত্রের সফর ব্যয় নিজেই বহন করেছেন। এরইমধ্যে সফর শেষে সোমবার (২৫ এপ্রিল) দেশে ফিরেছেন তারা।

বিপিসি চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ স্ত্রী-পুত্রসহ ঢাকা-চট্টগ্রাম জ্বালানি পাইপলাইন প্রকল্পের পাইপ দেখতে কানাডা গিয়েছিলেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রকল্পের প্রায় ৮৫ শতাংশ পাইপ এরইমধ্যে দেশে এসেছে। বাকি ১৫ শতাংশ পাইপও বিপিসি চেয়ারম্যানের কানাডা সফরের আগেই জাহাজীকরণ হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, পাইপের গুণগতমান যাচাই করতেই যদি কানাডা সফরে যাবেন তবে শিপমেন্টের পরে কেন এ সফর।

সফরে থাকা জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের যুগ্ম সচিব (প্রশাসন) ইলিয়াছ হোসেনের সঙ্গে কথা হলে মঙ্গলবার (২৬ এপ্রিল) বিকেলে তিনি  বলেন, ‘মূলত পাইপ দেখার জন্যই এ কানাডা সফর। কানাডার মতো দেশে পাইপলাইন স্থাপন প্রক্রিয়া কীভাবে সম্পন্ন হয়, সেটি দেখতেই বিপিসি চেয়ারম্যান ও আমরা সেখানে গিয়েছি। এখানে পণ্য জাহাজীকরণের আগে গেলাম বা পরে, সেটি মুখ্য নয়।’

সফরে যাওয়া সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (প্রশাসন-২ অধিশাখা) সৈয়দ মেহদী হাসান বলেন, ‘আমরা পাইপের গুণগত মান দেখার জন্য গিয়েছিলাম। যতটুকু দেখেছি, পাইপগুলো ঠিক আছে।’

 

তবে তাদের সফরের আগে পাইপ জাহাজীকরণ হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখনো সব পাইপ জাহাজীকরণ হয়নি। কিছু পাইপ এখনো জাহাজীকরণ হচ্ছে।’

এ বিষয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম জ্বালানি সরবরাহ পাইপলাইন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক পদ্মা অয়েল কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক মো. আমিনুল হক বলেন, ‘প্রকল্পের কাজ দ্রুত এগোচ্ছে। এরইমধ্যে বেশিরভাগ পাইপ কানাডা থেকে চলে এসেছে। বাকিগুলোও রয়েছে দেশের পথে।’

জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের গত বছরের ৭ ডিসেম্বরের পত্রসূত্র অনুযায়ী, ২৮.০০.০০০০.০৪০.২৫.০৩২.১৯ মোতাবেক বিপিসি চেয়ারম্যানকে দেওয়া কানাডা সফরের সরকারি আদেশে (জিও) উল্লেখ করা হয়, লাইন পাইপ ইন্সপেকশনের জন্য ৭-১৪ ডিসেম্বর আটদিন (ট্রাভেল টাইম বাদে) অথবা নিকটবর্তী সময়ে কানাডা সফরে ছয়জনকে অনুমতি দেওয়া হয়। জিও মোতাবেক এ ছয়জন হলেন- বিপিসির চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ, বিপিসি পরিচালক সৈয়দ মেহদী হাসান, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ ইলিয়াছ হোসেন, পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান, পাইপ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বিল্ডস্টোন কন্সট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান ডা. ওসমান গণি চৌধুরী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওমর গণি চৌধুরী।

 

জিও আদেশের শর্তে উল্লেখ করা হয়, প্রথম চারজনের (বিপিসি চেয়ারম্যান, পরিচালক, যুগ্ম সচিব, পদ্মা অয়েলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক) সফর ব্যয় বিল্ডস্টোন কন্সট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড বহন করবে। একই আদেশে বলা হয়, সফরে বিপিসি চেয়ারম্যানের স্ত্রী লায়লা মাসুদা এবং ছেলে সরওয়ার মোরশেদ কাদেরীও থাকবেন। তবে তাদের সফর ব্যয় নিজেরা বহন করবেন। ওই আদেশের পর গত বছরের ২১ ডিসেম্বর সৈয়দ মেহদী হাসান বিপিসি থেকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে যুগ্ম সচিব (প্রশাসন-২ অধিশাখা) হিসেবে পদায়িত হন।

সরকারি আদেশ মোতাবেক কানাডা সফর হলেও পাইপ জাহাজীকরণের পর কেন এ সফর, এ নিয়েই মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে সচেতন মহলে। আবার যে কর্মকর্তা চার মাস আগেই অন্য মন্ত্রণালয়ে বদলি হয়েছেন, বর্তমান প্রকল্পের সঙ্গে যার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই, সফরে কেনইবা তাকে সঙ্গে রাখা হলো- এ নিয়েও কথা আসছে।

 

এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী  বলেন, পাইপের কোয়ালিটি (মান) দেখার জন্য তাদের (বিপিসি কর্মকর্তাদের) কানাডা সফরের কথা। কিন্তু পাইপ শিপমেন্ট হওয়ার পর যদি তারা কানাডা যান তাহলে কোয়ালিটি দেখবেন কখন।

তিনি বলেন, ‘অন্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব যিনি বিপিসির এ প্রকল্পের সঙ্গে বর্তমানে সম্পৃক্ত নন, তাকে কানাডা সফরে সঙ্গে নেওয়া অপরাধ। এখানে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। এতে সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি তামাশায় রূপান্তরিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। আশা করবো, দুদক (দুর্নীতি দমন কমিশন) সেটি করবে। যেন ভবিষ্যতে কোনো সরকারি কর্মকর্তা এ ধরনের অনিয়ম করতে না পারেন।’

 

জ্বালানি বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে  বলেন, ‘প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বিপিসি। পুরো প্রকল্পের পাইপ এসেছে চীন থেকে। প্রকল্পের কাজও প্রায় শেষ দিকে। এ প্রকল্পের পাইপ দেখতে বিপিসির কোনো কর্মকর্তাকে চীন যেতে হয়নি। এবার ঢাকা-চট্টগ্রাম জ্বালানি সরবরাহ পাইপলাইন প্রকল্পের পাইপ চলে আসার পরও কেন এ কানাডা সফর, তা বোধগম্য নয়।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বছরে প্রায় ৩০ লাখ টন জ্বালানি তেল চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় নৌপথে পরিবহন করা হয়। এ খাতে ট্রানজিট লসসহ কোটি কোটি টাকার সিস্টেম লস হয় বিপিসির। এছাড়া চট্টগ্রাম থেকে অয়েল ট্যাংকার ঢাকায় পৌঁছাতে সময়ও লাগে বেশি। সময় ও অর্থ সাশ্রয়ের পাশাপাশি জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে ঢাকা-চট্টগ্রাম পাইপলাইন নির্মাণ করছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ।

 

বিপিসি সূত্রে জানা যায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম জ্বালানি তেল পাইপলাইন নির্মাণ প্রকল্পে ২০১৫ সালের জুন মাসে সম্ভাব্যতা যাচাই সম্পন্ন করে বিপিসি। পরের বছর ১৫ ফেব্রুয়ারি ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্ডিয়া লিমিটেডকে (ইআইএল) পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। সবশেষ প্রকল্পটি পদ্মা অয়েল কোম্পানির তত্ত্বাবধানে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে বাস্তবায়নের জন্য ২০১৭ সালের ১৪ ডিসেম্বর নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এ প্রকল্পে পাইপলাইনের দৈর্ঘ্য হবে প্রায় ২৪৯ দশমিক ৫৭ কিলোমিটার। এর মধ্যে চট্টগ্রাম থেকে নারায়গঞ্জের গোদনাইল পর্যন্ত সাতটি স্টেশনসহ ২৪১ দশমিক ২৮ কিলোমিটার ১৬ ইঞ্চি ব্যাসের ভূগর্ভস্থ পাইপলাইন নির্মাণ ও গোদনাইল থেকে ফতুল্লা পর্যন্ত দুটি স্টেশনসহ ৮ দশমিক ২৯ কিলোমিটার ১০ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপলাইন নির্মাণ হবে। যেখানে এইচডিডি (উচ্চতর ডেটা স্টোরেজ) প্রযুক্তির মাধ্যমে ২২টি নদীর তলদেশে ৮ দশমিক ৯৫ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপন হবে। এরই মধ্যে চট্টগ্রাম, ফেনী, কুমিল্লা, চাঁদপুর, মুন্সিগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ জেলার ১৯ উপজেলায় প্রকল্পের ২৮৪ দশমিক ৯২ একর জমি অধিগ্রহণ হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় কুমিল্লার বরুড়ায় স্থাপন হবে নতুন একটি ডিপো।

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালের ২৯ নভেম্বর প্রকল্পের জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগে পাঠানো ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় নির্ধারিত ছিল ২ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। পরবর্তীসময়ে কয়েক দফা সংশোধনী এনে ৫৩০ কোটি বাড়িয়ে ২০১৮ সালের ৯ অক্টোবর ২ হাজার ৮৬১ কোটি ৩১ লাখ টাকায় প্রকল্পের অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। এর মাসখানেক পরই ওই বছরের ৫ নভেম্বর প্রকল্পটির প্রশাসনিক অনুমোদন দেয় সরকার। এরপরই তৈরি হয় বহুমাত্রিক জটিলতা। একাধিক প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের বাধার মুখে নতুন করে ডিপিপিটি সংশোধন করে বিপিসি।

 

সংশোধিত ডিপিপিতে প্রকল্পের মাঝপথে কুমিল্লা থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত ৫৯ দশমিক ২৩ কিলোমিটার ৬ ইঞ্চি ব্যাসের ভূগর্ভস্থ জ্বালানি পাইপলাইন নির্মাণকাজ ছাঁটাই করে বিপিসি। এতে খরচও কমে ৩ দশমিক ০২ শতাংশ। ফলে সংশোধিত ডিপিপির আর্থিক মূল্য দাঁড়ায় ২ হাজার ৭৫৮ কোটি ৪৯ লাখ টাকা।

২০২০ সালের ১৯ মে সংশোধিত ডিপিপির প্রশাসনিক অনুমোদন দেয় জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ। পরবর্তীসময়ে তৃতীয় দফায় আবারও সংশোধিত হয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় বাড়ে ৪১৩ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। সবশেষ গত ২২ জানুয়ারি তিন হাজার ১৭১ কোটি ৮৫ লাখ টাকার এ মেগা প্রকল্পের প্রশাসনিক অনুমোদন দেয় সরকার। প্রকল্প বাস্তবায়নে ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে এক হাজার ৬৮৭ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। এ বছরের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা।