চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) কানন প্রভা পাল নামে ষাটোর্ধ্ব কভিড রোগী চিকিৎসাধীন। একই সময়ে তাঁর ছেলে করোনা আক্রান্ত শিমুল পাল (৪২) ছিলেন হাসপাতালের আইসোলেশন কেন্দ্রে। একদিকে আইসিইউতে মায়ের অবস্থা সংকটাপন্ন, অন্যদিকে ছেলের শারীরিক অবস্থা অবনতির দিকে। এক পর্যায়ে শিমুলের জন্য আইসিইউ সাপোর্ট জরুরি হয়ে পড়ে। কিন্তু হাসপাতালে ১৮টি আইসিইউ-এইচডিইউ কোনোটিই খালি না থাকায় বিপাকে পড়েন চিকিৎসকরা। এ সময় স্বজনরা লিখিতভাবে আবেদন করে মায়ের পরিবর্তে ছেলেকে আইসিইউতে নেওয়ার জন্য। তার পর মাকে আইসিইউ থেকে আইসোলেশনে স্থানান্তর করা হয়। আর ছেলেকে নেওয়া হয় আইসিইউতে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মা প্রাণ হারান। গত মঙ্গলবার দুপুরে এই হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে। ছেলে শিমুলের অবস্থা এখনো সংকটাপন্ন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
বেসরকারি পার্কভিউ হাসপাতালে ১২টি আইসিইউ-এইচডিইউয়ের মধ্যে একটি শয্যাও খালি না থাকায় চরম দুশ্চিন্তায় ছিল আইসোলেশনে থাকা মো. মাঈনুদ্দিনের (৭০) স্বজনরা। সংকটাপন্ন মাঈনুদ্দিনের জন্য গতকাল বৃহস্পতিবার সরকারি উচ্চ পর্যায় থেকে একটি আইসিইউ শয্যার জন্য সুপারিশ করা হয়। গতকাল বিকেলে একটি শয্যা খালি হলে সেখানে ওই রোগীকে স্থানান্তর করা হয়।
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল কিংবা পার্কভিউ হাসপাতালেই শুধু সংকট নয়, বন্দর নগরীর সরকারি-বেসরকারি কোনো হাসপাতালেই আইসিইউ শয্যা মিলছে না। জানা গেছে, সরকারি হাসপাতালে ৪৩টি ও বেসরকারিতে প্রায় দেড় শ আইসিইউ শয্যা আছে। বর্তমানে পরিস্থিতি এতই খারাপ যে কোনো রোগী মারা গেলে অথবা সুস্থ হলেই শুধু অপেক্ষমাণদের মধ্য থেকে কারো কারো ভাগ্যে জুটছে আইসিইউ। তা ছাড়া সাধারণ শয্যা (আইসোলেশন) নিয়েও সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে হাহাকার শুরু হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নগরের করোনার চিকিৎসাসেবা চলা বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে সাধারণ শয্যা খালি নেই। এর মধ্যে প্রধান প্রধান হাসপাতালগুলোতে শয্যার অতিরিক্ত রোগী ভর্তি রয়েছে। নগরের চারটি কভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালের মধ্যে প্রধান দুটিতে (চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল) আইসিইউসহ সাধারণ শয্যা খালি নেই। এর মধ্যে জেনারেল হাসপাতালে শয্যার অতিরিক্ত রোগী চিকিৎসাধীন। সব মিলে সরকারি জেনারেল হাসপাতালে গতকাল বিকেল পর্যন্ত ৯৬.৫৯ শতাংশ শয্যা খালি নেই। আইসিইউ শয্যা খালি নেই একটিতেও।
গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় চমেক হাসপাতালে ৩০০ শয্যার করোনা ওয়ার্ডে ২৯৯ জন চিকিৎসাধীন ছিলেন। চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ১৫৮টি শয্যার বিপরীতে ১৬৭ জন ভর্তি আছে। এ ছাড়া বিআইটিআইডি হাসপাতালে ৫০ শয্যার মধ্যে ৪৩ জন এবং জেনারেল হাসপাতালের দ্বিতীয় ইউনিট হলিক্রিসেন্ট হাসপাতালে ৫০ শয্যার মধ্যে ৩০ জন করোনা রোগী ভর্তি আছে। এর মধ্যে এসব হাসপাতালে মোট ৪৩টি আইসিইউ শয্যা থাকলেও খালি নেই। সব হাসপাতালেই করোনা রোগী ভর্তি।
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের করোনা চিকিৎসাসেবার প্রধান সমন্বয়কারী সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. আবদুর রব কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আইসিইউ-এইচডিইউ খালি নেই। আইসোলেশনে শয্যার অতিরিক্ত রোগী ভর্তি আছে। এর মধ্যে পাঁচ থেকে সাতজনের আইসিইউ শয্যা প্রয়োজন হলেও খালি না থাকায় স্থানান্তর করা যাচ্ছে না।’ গত মঙ্গলবার আইসিইউতে মায়ের শয্যায় ছেলেকে স্থানান্তরের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক বলেন, ‘আমাদের তাদের পরিবারের সদস্যরা লিখিত ও মৌখিকভাবে অনুরোধ করার কারণে আইসিইউতে ছেলেকে ভর্তি করে মাকে আইসোলেশনে স্থানান্তর করা হয়। ছেলের অবস্থা এখন সংকটাপন্ন। আইসোলেশনে নেওয়ার পাঁচ-ছয় ঘণ্টা পর মা মারা যান।’
মুমূর্ষু শিমুলের শারীরিক অবস্থার বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালের আরএমও ডা. রাজদ্বীপ গতকাল বিকেলে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অক্সিজেন স্যাচুরেশন কখনো ৬০ আবার কখনো ৮০ বা ৮২ ওঠানামা করছে। অবস্থা ক্রিটিক্যাল।’
পার্কভিউ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. এ টি এম রেজাউল করিম বলেন, ‘১২টি আইসিইউয়ের একটিও খালি নেই। সব কটিতে করোনা রোগী। ৮০টি আইসোলেশন (কেবিনসহ) শয্যায় ৯০ জন ভর্তি আছে। এর মধ্যে প্রায় দেড় শতাংশ রোগী আইসিইউয়ের প্রয়োজন হলেও শয্যা খালি না থাকায় দেওয়া যাচ্ছে না। খালি হলে ভর্তি করা হচ্ছে। চট্টগ্রামে আইসিইউয়ের মারাত্মক সংকটের কারণে আজকে (বৃহস্পতিবার) আমরা উদ্যোগ নিয়ে হাসপাতালে আরো ১২টি আইসিইউ ব্যবস্থা করছি। আগামীকাল (আজ শুক্রবার) এসব শয্যায় রোগী ভর্তি করা হবে।’
চট্টগ্রাম বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ডা. লিয়াকত আলী খান বলেন, ‘নগরে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে করোনার চিকিৎসায় প্রায় দেড়শ আইসিইউ শয্যা থাকলেও সবগুলোতেই রোগী ভর্তি আছে। হাসপাতালগুলোতে সাধারণ শয্যারও সংকট দেখা দিয়েছে। শয্যা বাড়ানোর পরও রোগী বেশি হওয়ায় বরং অতিরিক্ত রোগী ভর্তি করা হচ্ছে।’
ম্যাক্স হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে থাকা এই চিকিৎসক বলেন, ‘হাসপাতালে ১৫টি আইসিইউ-এইচডিইউতে রোগী পূর্ণ। গত কয়েক দিন ধরে প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ জন আইসিইউ খুঁজলেও খালি না থাকায় দিতে পারছি না। ৯০টি আইসোলেশনের শয্যায় অতিরিক্ত রোগী ভর্তি আছে। এভাবে প্রতিটি বেসরকারি হাসপাতালেও শয্যা সংকট দেখা দিয়েছে।’
এদিকে গতকাল চট্টগ্রামে এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ রোগী শনাক্ত হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় তিন হাজার ৫১৫টি নমুনা পরীক্ষায় এক হাজার ৩১৫ জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের হার ৩৭.৪১ শতাংশ। এদিন চট্টগ্রামে করোনা আক্রান্ত হয়ে ১৭ জন মারা গেছে। এর মধ্যে নগরে আট ও জেলায় ৯ জন।