 
                                            
                                                                                            
                                        
স্টকহোমে বিউবেনশিয়ার আদলে ছোট্ট শহর নোহাটা। এখন স্রেফ উইন্টার, কেউ হুট করেই এমন কিছু ছুড়ে দিতে পারে না। সময়টা আরলি এপ্রিল। মৃদু শীতের জাদরেল মেজাজটা স্যুট-বুটের কাছেই নিষ্পেষিত হচ্ছে। ষোড়শ শতাব্দীতে এ শহরের নিউরন বেয়ে অনুভূতি প্রবাহ করেছিল সুইডিশ সাহিত্য। শহরকে গভীরভাবে আঁকেন কেউ কেউ। বিষয়গুলো স্মৃতি রোমন্থনের।
বিগলিত লিন্ড এ সময়টায় অ্যাডমিট আছেন সেইন্ট গরান হসপিটালে। গত দু’ সপ্তাহ। এখনকার সময়টা একটু দীর্ঘ। পরিবারের কারো সাথে দেখা হচ্ছে না। এখানেও কেউ আসছেন না। ফোনে নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে একমাত্র মেয়ে মারিয়ার সাথে। সে প্রচুর কান্না করছে। এ সময়টা জেসিকার সাথে পার্কগুলোতে একটা উল্লাসিত সময় কাটানোর কথা ছিল। স্টারবাকসে কফি, সন্ধ্যার ক্যাফেটেরিয়ায় নৈশভোজ ও হেঁটে বেড়ানো।
সেই ছোট্ট জেসিকাকে এখন সবাই চেনে। টেনিস খেলছে সে। সাত-পাঁচ কল্পনায়; বুকের ভেতর হিম হয়ে আসা একটা চাপাকান্না কাজ করছিল। পলিফোনিক রিংটোনের ফোনটা বাজছে; মৃধা। সে নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখছে।
– হ্যালো।
– কেমন যাচ্ছে আপনার সময়? মারিয়ার হাজব্যান্ড মৃধা, শব্দটা স্থির হয়ে আছে। সময় বোধ হয় কিছু একটার জন্য অপেক্ষা করছিল!
– খুব একটা খারাপ না। এখন কিছুটা ভালো। নিজের বিষয়ে এর চেয়ে বেশি কিছু আর বললেন না। জেসিকা কী করছে?
– সে কিচেনে আছে; ডিনারের জন্য কিছু প্রিপেয়ার করছে। আপনার কাছে যেতে চেয়েছিল। হসপিটাল অথরিটির অনুমতি নেই।
– ও আচ্ছা।
– আই হোপ, আমাদের দ্রুতই দেখা হবে। সে রাতে আপনাকে কানেক্ট করবে।
পৃথিবী এখন অনেকটাই থমকে আছে। হাজারটা স্বপ্নের অপমৃত্যু, নির্বিকার সময়, ভ্যাকুয়াম শূন্য নিরবতা আরও একবার দাঁড় করিয়েছে মানবিক পৃথিবীকে।
– মারিয়াকে দেখ মৃধা। সে এখনো ছেলেমানুষ; আমাকে নিয়ে হয়তো খুব দুঃশ্চিন্তা করছে।
– হুম। এটা এমন কিছু নয়।
– আমার এটা দুর্ভাগ্য নয়। ছেলেবেলা কিছুটা কষ্টে কাটিয়েছি। বিয়ের পরের সময়টাও। মারিয়া বাবা হারিয়েছিল। এরপর ওকে কোলে পিঠে করে বড় করে তুলেছি। কিসের দুর্ভাগ্য?
– ইউ আর এ হ্যাপি ওমেন।
– হা, সময়টা নিঃসন্দেহে ভালো কেটেছে এ পৃথিবীতে। কাজে, ছুটিতে, সংসারে, দেশে-বিদেশে ও দেওয়া-নেওয়ায়। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লেন। ভালোই ছিলাম। তবে এখন কঠিন একটা সময় পার করছি। ও ভালোটা দেখে ও রেখে যেতে পারব এ জন্যই হয়তো ভালো লাগছে।
আক্ষেপের কোনো জায়গা কি এ মুহূর্তে কাজ করছে বিগলিত লিন্ডের। হয়তো হা, হয়তো না। রহমান মৃধা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। কী বলবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না। এরপর ফোন কেটে দিলেন।
কথা বলার মাঝে মাঝে কিছুটা উচ্চ শব্দে হেসে উঠছিলেন তিনি।
জেসিকা টেবিলে খাবার দিয়েছে। মারিয়া নিজ রুমেই টেবিলে চুপচাপ গুটি পাকিয়ে বসে আছে। জেসিকা বেশ কয়েকবার নক করল। সে নিজের জায়গা ছেড়ে খাবার টেবিলে আসেনি। ছ’টার সময় ডিনার করার কথা, এখন রাত প্রায় এগারোটা। জেসিকা খাবার টেবিলে অপেক্ষা করছে। মৃধা সাহেব মারিয়ার রুমের দিকে এগিয়ে গেলেন।
– কী ব্যাপার? ডিনার করবে না?
– উঁহু। আজ খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না।
– দুঃশ্চিন্তা করো না। কিছুদিনের মধ্যেই ডক্টর জানিয়েছেন, ওনার সাথে দেখা করার সুযোগ হবে। সেরে উঠবেন উনি। খেয়ে নাও কিছু। মারিয়া এরপর শুধু একবার পাশ ফিরলেন।
বিগলিত লিন্ড হার মেনেছেন, কোভিড-১৯ এ। নিথর দেহের পাশে নাতনি জেসিকা ও মেয়ে মারিয়া দাঁড়িয়ে আছেন। ওনার চোখ দুটো খোলা। সুন্দর এ বসন্ত বোধ হয় আরও কিছুটা দিন জেসিকার সাথে ঘুরে বেড়াতে চেয়েছিলেন। দু’জন নিহর দেহটির পাশে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। অবাক বিস্ময়ে। নক্ষত্রেরও কি একদিন মরে যেতে হয় না-কি? হয়তো হয়।
জেসিকা ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। মনে হলো কেউ একজন হাত ধরে আছে!