>> ২০১৮ সালের ডিসেম্বের শেষে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা
>> ২০১৭ সালের ডিসেম্বের শেষে ছিল ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা
>> ২০১৬ সাল খেলাপি ঋণ ছিল ৬২ হাজার ১৭২ কোটি টাকা
>> ২০১৫ সাল খেলাপি ঋণ ছিল ৫১ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা
ঋণ দিচ্ছে কিন্তু আদায় হচ্ছে না। ফলে বিপাকে পড়েছে ব্যাংকগুলো। নানা উদ্যোগেও খেলাপি ঋণের লাগাম টানতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে নড়বড়ে অবস্থায় রয়েছে দেশের ব্যাংকিং খাত। ২০১৮ সাল শেষে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা। যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১০ দশমিক ৩০ শতাংশ।
খেলাপি ঋণের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের তৈরি করা ডিসেম্বর’১৮ প্রান্তিকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে ঋণ বিতরণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ লাখ ১১ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৩ হাজার ৯১১ কোটি টাকা, যা ডিসেম্বর’১৭ শেষে ছিল ৭৪ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা বা ৯ দশমিক ৩১ শতাংশ। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৯ হাজার ৬০৮ কোটি টাকা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সুশাসনের অভাব, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, অব্যবস্থাপনা ও নানা অনিয়মে দেয়া ঋণ আর আদায় হচ্ছে না। অন্যদিকে বিশেষ সুবিধায় পুনর্গঠন করা ঋণ আবার খেলাপি হচ্ছে। ফলে লাগামহীনভাবে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। এতে করে জনগণের আমানত গ্রহণ করলেও তার সুরক্ষা দিতে পারছে না ব্যাংক। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামীতে ব্যাংকিং খাতে ভয়াবহ রূপ নেবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, অনিয়ম অব্যবস্থাপনার ও রাজনৈতিক বিবেচনায় যাচাই-বাছাই ছাড়াই ঋণ প্রদান করা হচ্ছে। এ ঋণ আদায় হচ্ছে না। এছাড়া বিশেষ সুবিধায় ঋণ পুনর্গঠন করা খেলাপিগুলো নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করছে না। এসব কারণে মন্দ ঋণের পরিমান বাড়ছে।
সাবেক এ গভর্নর বলেন, খেলাপিদের যদি যথাযথ শাস্তির আওতায় নিয়ে না আসা যায় তাহলে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। যারা বড় ঋণখেলাপি তাদের বেশিরভাগই প্রভাবশালী। ঋণ নিয়ে ফেরত দিচ্ছে না। তাই খেলাপি ঋণের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শক্ত অবস্থানে যেতে হবে। একইসঙ্গে ব্যাংকগুলোকে সময়োচিত ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক (সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ও বিডিবিএল) ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৪৮ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ২৯ দশমকি ৯৬ শতাংশ। এই সময় ব্যাংকগুলোর মোট বিতরণ করা ঋণ দাঁড়ায় এক লাখ ৬২ হাজার ৫২০ কোটি টাকা। এক বছর আগে ডিসেম্বর’১৭ শেষে রাষ্ট্রীয় খাতের ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করেছিল এক লাখ ৪০ হাজার ৭৬৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৭ হাজার ৩২৬ কোটি টাকা যা মোট বিতরণ করা ঋণের ২৬ দশমিক ৫২ শতাংশ। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে রাষ্টায়ত্ত ব্যাংকের খেলাপি বেড়েছে সাত হাজার ৯২৬ কোটি টাকা।
২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে বিশেষায়িত দুই ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে চার হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ১৯ দশমিক ৪৬ শতাংশ। ২০১৭ সালের বিশেষায়িত দুটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল পাঁচ হাজার ৪২৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে ৬৩৮ কোটি বা ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ কমেছে।
আলোচিত সময়ে বেসরকারি ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ করেছে ছয় লাখ ৮৮ হাজার ৯৩৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩৮ হাজার ১৩৯ কোটি টাকাই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। যা মোট ঋণের পাঁচ দশমিক ৫৪ শতাংশ। এক বছর আগে ডিসেম্বর’১৭ শেষে বেসরকারি ব্যাংক ঋণ বিতরণ করেছে ছয় লাখ তিন হাজার ৬০৩ কোটি টাকা এবং খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২৯ হাজার ৩৯৬ কোটি টাকা যা মোট বিতরণ করা ঋণের চার দশমিক ৮৭ শতাংশ। বছরের ব্যবধানে এসব ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে আট হাজার ৭৪৩ কোটি টাকা।
এছাড়া বিদেশি ৯ ব্যাংক ঋণ বিতরণ করেছে ৩৫ হাজার ৩৬৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের ছয় দশমিক ৪৭ শতাংশ। ২০১৭ সালে খেলাপি ঋণ ছিল দুই হাজার ১৫৪ কোটি টাকা।
নিয়ম অনুযায়ী, খেলাপি ঋণ তিনটি শ্রেণিতে বিভাজন করা হয়। একটি নিম্নমান, সন্দেহজনক এবং মন্দ বা ক্ষতিজনক মান। মন্দ বা ক্ষতিজনক মানের ঋণ আদায় হবে না বলে ধারণা করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, মোট খেলাপি ঋণের ৭৩ হাজার কোটি টাকাই মন্দ ঋণ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের যে পরিমাণ ঋণ বিতরণ করে তার বেশিরভাগই আমানতকারীদের অর্থ। আমানতকারীদের অর্থ যেন কোনো প্রকার ঝুঁকির মুখে না পড়ে সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা আছে। এর একটি হলো প্রভিশন সংরক্ষণ। নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকের অশ্রেণিকৃত বা নিয়মিত ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ থেকে পাঁচ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হয়।
এছাড়া নিম্নমান বা সাব স্ট্যান্ডার্ড ঋণের বিপরীতে রাখতে হয় ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ বা কুঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। ব্যাংকের আয় খাত থেকে অর্থ এনে এ প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয়।