 
                                            
                                                                                            
                                        
দুর্নীতির মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের সাজা হওয়ার পর তাকে পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের পুরনো কারাগারে রাখা হয়েছে। র্যাব-পুলিশের বিশেষ নিরাপত্তায় ঢাকা মেট্রো-গ ১১-৭০৪৪ নম্বরের একটি নিসান ব্র্যান্ডের গাড়িতে তাকে সেখানে নেওয়া হয়। ওই গাড়িটি পুলিশের একজন নারী ডিসির। কারা আনুষ্ঠানিকতা শেষে তাকে কারাগারের প্রশাসনিক ভবনের নিচতলার একটি কক্ষে রাখা হয়। যেটি এক সময় ওই কারাগারের সিনিয়র জেল সুপারের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহূত হতো। খালেদা জিয়া আপাতত সেখানেই থাকবেন এবং একজন ভিআইপি বন্দি হিসেবে জেল কোড অনুযায়ী সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাবেন। কারা-সংশ্নিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
পুলিশ ও কারা সূত্র জানায়, গতকাল বৃহস্পতিবার বহুল আলোচিত জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় রায়ের পর খালেদা জিয়াকে বকশীবাজারের বিশেষ কারাগার থেকে র্যাব-পুলিশের কঠোর নিরাপত্তায় কারা অধিদপ্তরের ডিআইজির (ঢাকা বিভাগ) কার্যালয়ের সামনের সড়ক হয়ে কারা আবাসিক এলাকা দিয়ে সাবেক কেন্দ্রীয় কারাগারে নেওয়া হয়।
কারা সূত্র জানায়, ওই কারাগারে বিএনপি চেয়ারপারসন ছাড়া আর কোনো বন্দি নেই। ২০১৬ সালের ২৯ জুলাই কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার স্থানান্তর হলে সেখান থেকে সব বন্দিকে স্থানান্তর করা হয়। এরপর কারাগারটি খালি পড়ে ছিল। প্রায় দেড় বছর পর পুরনো কারাগারে সাজাপ্রাপ্ত বন্দি হিসেবে খালেদা জিয়াকে রাখা হলো। আপাতত জেল সুপারের কক্ষে তাকে রাখা হলেও তার জন্য নারী সেলও প্রস্তুত রয়েছে। এরইমধ্যে ওই সেল ঘষামাজা করা হয়েছে।
কারা অধিদপ্তরের ডিআইজি (ঢাকা বিভাগ) তৌহিদুল ইসলাম বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে পুরনো কারাগারের প্রশাসনিক ভবনের নিচ তলায় জেল সুপারের কক্ষে আপাতত রাখা হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাকে স্থানান্তর করা হতে পারে।
এ কারা কর্মকর্তা বলেন, একজন সাজাপ্রাপ্ত বন্দি হিসেবে জেল কোড ও আইন অনুযায়ী খালেদা জিয়া সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাবেন। সে বিষয়ে জেল কর্তৃপক্ষ সতর্ক রয়েছে।
কারাগারে খালেদা জিয়া কোনো পরিচারিকা রাখার সুযোগ পাবেন কি-না এমন প্রশ্নে ডিআইজি তৌহিদুল ইসলাম বলেন, জেল কোড দেখে পরে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
কারাগারের অপর একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, একজন ডেপুটি জেল সুপারের নেতৃত্বে ছয়জনের নারী কারারক্ষীসহ একটি টিম খালেদা জিয়ার বিষয়টি দেখভাল করছে। তার সঙ্গে সার্বক্ষণিক একজন নার্স থাকবেন। তিনি চাইলে বা প্রয়োজন হলে চিকিৎসকও থাকবেন। জেল কোড অনুযায়ী তিনি কারাগার থেকে সকালে সবজি, ডিম ও রুটি পাবেন। দুপুরে ভাত, মাছ ও মাংস পাবেন। তবে ভিআইপি বন্দি হিসেবে তার চাহিদা মতো খাবার বরাদ্দ রয়েছে। কারা সূত্র জানিয়েছে, গতকাল কারাগারে নেওয়ার কিছু সময় পর খালেদা জিয়াকে পেঁপের জুস এবং আপেল, কমলা ও আঙুর খেতে দেওয়া হয়। এদিকে খালেদা জিয়াকে রাখার পর সাবেক এ কেন্দ্রীয় কারাগারকে ‘বিশেষ জেল’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে কারা কর্তৃপক্ষ।
একজন কর্মকর্তা বলেন, খালেদা জিয়াকে যে কক্ষটিতে রাখা হয়েছে সেখানে কোনো শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেই। কক্ষে একটি সিলিং ফ্যান রয়েছে। তাকে একটি চৌকি, একটি চেয়ার ও টেবিল দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে তার চাহিদা অনুযায়ী জেল কোড সমর্থন করে এমন সরঞ্জামও সরবরাহ করা হবে। ওই কক্ষে আপাতত তাকে একটি টেলিভিশন দেওয়া হয়েছে, যেটাতে তিনি কেবল বিটিভি দেখতে পারবেন। প্রতিদিন তিনি একটি পত্রিকা পাবেন। তবে তিনি চাইলে একাধিক পত্রিকা কিনে পড়তে পারবেন। এ ছাড়া কারা লাইব্রেরি থেকে বিভিন্ন ধরনের বই পড়তে পারবেন। খালেদা জিয়ার কক্ষে গতকাল সন্ধ্যায় একটি ফ্রিজও দেওয়া হয়। কারা কর্তৃপক্ষের সেন্সরে সাত দিনে একবার চিঠি লিখতে পারবেন। স্বজনরা মাসে একবার প্রথম শ্রেণির কয়েদিদের সঙ্গে দেখা করতে পারেন। তখন তারা শুকনো খাবার ও ফল নিতে পারবেন। এ ধরনের বন্দিদের ক্ষেত্রে পছন্দ অনুযায়ী খাবার দেওয়া হয়। বিকেলের নাশতায় থাকে ফলমূল।
কারাগারে নেওয়ার পর খালেদা জিয়ার সঙ্গে কথা বলেছেন এমন একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, কারাগারে আসার পর খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়েছে। তিনি সুস্থ রয়েছেন।
কারা অধিদপ্তরের সাবেক একজন ডিআইজি বলেন, খালেদা জিয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী। সরকার চাইলে তাকে কারাগারে নানা সুযোগ-সুবিধা দিতে পারে। প্রয়োজন হলে তার কক্ষে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রও দিতে পারেন। সাধারণত সাজাপ্রাপ্ত একজন বন্দির খাবার জেল কর্তৃপক্ষ সরবরাহ করলেও সরকারের নির্বাহী আদেশে তা বাইরে থেকেও সরবরাহ করা যেতে পারে। এর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় গ্রেফতার হয়ে তিনি যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেয়েছিলেন, এবারও সেসব সুযোগ-সুবিধা দিতে বাধা নেই।
এদিকে পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, খালেদা জিয়াকে কারাগারে রাখার পর ওই এলাকার নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। কারারক্ষী, পুলিশ ও র্যাব ছাড়াও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন ওই এলাকায় দায়িত্ব পালন করছেন। সন্ধ্যায় কারা অধিদপ্তরে ঊর্ধ্বতন কারা কর্মকর্তাদের সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা বৈঠকও করেছেন।
সামাজিক মর্যাদা বিবেচনায় পুরনো কারাগারে :এদিকে গতকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, খালেদা জিয়া তার সামাজিক মর্যাদা, অবস্থান ও বয়সের বিবেচনায় জেল কোড অনুযায়ী সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাবেন। সার্বিক বিষয় বিবেচনা করেই তাকে পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়েছে।
খালেদা জিয়ার বর্তমান বাসভবনকে সাবজেল হিসেবে ঘোষণা করা হবে কি-না- জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এমন সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে যেকোনো সময় যেকোনো সিদ্ধান্ত হতে পারে।
প্রায় ৩৬ বছরের রাজনৈতিক জীবনে খালেদা জিয়া এবারই কোনো মামলায় দণ্ড পাওয়ার পর কারাগারে গেলেন। এর আগে ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তিনি গ্রেফতার হন। ওই সময় তাকে সংসদ ভবন এলাকায় বিশেষ কারাগারে রাখা হয়। এছাড়া বিভিন্ন সময় তিনবার তাকে পুলিশ আটক করে। তবে কখনও কারাগারে যেতে হয়নি। ১৯৮৩ সালের ২৮ নভেম্বর, ১৯৮৪ সালের ৩ মে, ১৯৮৭ সালের ২১ নভেম্বর তাকে আটক করে পুলিশ। ১৯৮৭ সালে রাজধানীর হোটেল পূর্বাণী থেকে তাকে আটক করে কয়েকজন নেতাকর্মীসহ মতিঝিল থানায় নেওয়া হয়।