এ জন্য উন্নত বিশ্বের মতো ব্যাংক লেনদেন হাতের মুঠোয় আনতে ফিন টেক প্রযুক্তি ব্যবহারে তাগিদ দেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিদেশি সফটওয়্যার কোম্পানির ওপর নির্ভর না করার নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে।
এসব নির্দেশনা দিয়ে মঙ্গলবার (২ জুন) অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান এবং এমডিদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে। এসব নির্দেশনার একটি কপি বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনরের কাছেও পাঠানো হয়েছে। নির্দেশনা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলোকে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
নির্দেশনায় বলা হয়, করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় সরকার মোট এক লাখ তিন হাজার ১১৭ কোটি টাকার বিভিন্ন আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়, যা দেশের জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) ৩.০৭ শতাংশ। সরকারের নির্দেশনায় বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক প্রণোদনা প্যাকেজসমূহ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এ পর্যন্ত ৬৬টি সার্কুলার জারি করা হয়েছে।
এর মাধ্যমে রফতানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকা, ক্ষতিগ্রস্ত এসএমই খাতে ২০ হাজার কোটি টাকা, রফতানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) জন্য ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা, প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট রিফাইন্যান্স স্কিমের আওতায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা এবং উৎপাদনমুখী শিল্প কারখানার জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ সুবিধা বা চলতি মূলধন ঋণের আর্থিক সহায়তা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে।
এছাড়া কৃষি খাতে ভর্তুকি বাবদ সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা, কৃষি খাতে চলতি মূলধন সরবরাহের উদ্দেশ্যে পাঁচ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন স্কিম ঘোষণা করা হয়েছে। প্রি-সঞ্চয় ব্যাংক, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক ও পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের জন্য দুই হাজার কোটি টাকার তহবিল, বাণিজ্যিক ব্যাংকের স্থগিত সুদের ভর্তুকির জন্য দুই হাজার এবং নিম্ন আয়ের পেশাজীবী, কৃষক ও ক্ষুদ্র/প্রান্তিক ব্যবসায়ীদের জন্য তিন বছর মেয়াদি তিন হাজার কোটি টাকার আবর্তনশীল পুনঃঅর্থায়ন স্কিমের আওতায় বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
ব্যাংকভিত্তিক এসব প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে ব্যাংকসমূহ বিশেষ করে রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকসমূহের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার অনুযায়ী প্রণোদনা প্যাকেজসমূহের সঠিকভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও পরিচালনা পর্ষদের কার্যকরভাবে সম্পৃক্ত থেকে যথাসময়ে প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন করতে হবে।
এ জন্য ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সভায় প্রণোদনা প্যাকেজসমূহের বিভিন্ন বিষয়াদি যেমন-প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী বা শিল্পপ্রতিষ্ঠান নির্বাচন, সুদের হিসাবায়ন, অর্থায়নের উৎস, ঋণের মেয়াদকাল, ব্যাংক-ক্লায়েন্ট সম্পর্কের ভিত্তিতে ঋণ বিতরণে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ভূমিকা, বাংলাদেশ ব্যাংকে ঋণ অনুমোদন প্রক্রিয়া ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। যাতে পরিচালনা পর্ষদের প্রতিটি সদস্য, সাম্যক ধারণা লাভ করতে পারেন এবং ঋণ প্রদান কার্যক্রমে সিদ্ধান্ত গ্রহণে যথাযথভাবে ভূমিকা রাখতে পারেন।
নির্দেশনায় আরও বলা হয়, ওয়ান স্টপ সার্ভিসের মাধ্যমে সেবা প্রদান এবং কৃষক ও প্রান্তিক উদ্যোক্তাদের দ্রুততম সময়ে ঋণের অর্থ মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) মাধ্যমে সরাসরি বিতরণের বিষয়েও ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বিবেচনা করতে পারেন।
করোনা পরিস্থিতিতে গ্রাহকদের স্বশরীরে ব্যাংকে গিয়ে ব্যাংকিংসেবা গ্রহণ সংক্রমণ ঝুঁকি বাড়ায়। তাই অ্যাপস বা ডিজিটাল ওয়ালেটভিত্তিক ব্যাংকিংসেবা চালু হলে গ্রাহককে স্বশরীরে ব্যাংকে আসতে হবে না। আধুনিক ফিন টেক (FinTech) প্রযুক্তি সারাবিশ্বের ব্যাংক লেনদেনকে গ্রাহকের হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে। মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) ও ডিজিটাল ওয়ালেট সেবার মাধ্যমে গ্রাহক সহজেই ঘরে বসে পণ্য ক্রয়-বিক্রয়সহ সব ধরনের ব্যাংক লেনদেন ও পেমেন্ট সেটেলমেন্ট করতে পারেন। প্রবাসী বাংলাদেশিরাও মানি এক্সচেঞ্জ হাউসে না এসে ঘরে বসে অর্থ প্রেরণ করতে পারবে।
গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী যুগোপযোগী প্রযুক্তিনির্ভর ব্যাংকিং প্রাডাক্ট চালুর মাধ্যমে গ্রাহকের কাছে বিভিন্ন সেবা পৌঁছানো যেতে পারে। ব্যাংকিং খাতে প্রযুক্তি ব্যবহারে বিদেশি সফটওয়্যার কোম্পানির ওপর নির্ভর না করে দেশীয় সফটওয়্যার ব্যবহারের জন্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা রয়েছে।
এ অবস্থায় সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজসমূহ সঠিকভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরিচালনা পর্ষদ সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারসমূহ বিস্তারিত আলোচনাকরত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং বর্তমানে করোনাজনিত সৃষ্ট পরিস্থিতিতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে নিরাপদ ব্যাংকিংয়ের জন্য ডিজিটাল ওয়ালেটভিত্তিক বা অ্যাপসভিত্তিক ও ডিজিটাল ব্যাংকিংসেবা প্রচলনের উদ্যোগ গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।
এদিকে এ প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন ঠিক মতো হচ্ছে কি-না, তা দেখতে তিন স্তরে তদারকি হবে। প্যাকেজ বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি মনিটরিং টিম গঠন করা হবে। পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) নেতৃত্বে আলাদা আলাদা মনিটরিং সেল গঠন করা হবে। প্যাকেজে কোনোভাবেই যাতে অনিয়ম না হয় সে বিষয়ে কঠোর মনিটরিং করবে সেলগুলো।
এ দুটি সেলের কার্যক্রম তদারকি করবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেল। মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ যৌথভাবে এ তদারকির কাজ করবে। অর্থাৎ ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সরকারের প্রণোদনা বাস্তবায়নে তিন স্তরে তদারকি হবে। মনিটরিংয়ের মূল কাজ হবে বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন ঠিক মতো হচ্ছে কি-না, তা পর্যবেক্ষণ করা। পাশাপাশি প্যাকেজের অর্থ কীভাবে ব্যবহার হচ্ছে, যাদের জন্য প্যাকেজ করা হয়েছে তারা সহায়তা পাচ্ছেন কি-না, কোনো ঋণখেলাপি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এর থেকে কোনো ধরনের সহায়তা পাচ্ছে কি-না, তাও খতিয়ে দেখা হবে।