আমি দিন এনে দিন খাই। অভাবের সংসার। সারা জীবনের সঞ্চয়ের টাকা দিয়ে ৬ মাস আগে কিস্তিতে একটি গাড়ি কিনেছি। দুর্ভাগ্যক্রমে সেটির সঙ্গে দুর্ঘটনায় কলেজ ছাত্র রাজীবের মৃত্যু। হাইকোর্ট আমাকে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে রাজীবের পরিবারকে দিতে বলেছে। আমি তো এত টাকা এক সঙ্গে কখনো চোখে দেখিনি। কিভাবে দেব তার পরিবারকে।
বুধবার বেলা ১২টার দিকে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতের বারান্দায় এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন স্বজন পরিবহনের মালিক আসাদুজ্জামান রাজু। তিনি বলেন, আমার যদি সমর্থন থাকত আমি রাজীবের পরিবারকে টাকা দিয়ে দিতাম। আদালতের নির্দেশকে তো কখনো অমান্য করা যায় না। স্বজন পরিবহনের মালিক বলেন, ৬ মাস আগে ৫ লাখ ২০ হাজার টাকা ডাউন পেমেন্ট দিয়ে র্যাংগস মোটরস থেকে একটি গাড়ি কিস্তিতে নিয়েছি। স্বজন পরিবহনের ব্যানারে গাড়িটি রোডে চলে। এক শিফট আমি চালাই আরেক শিফট চালায় ড্রাইভার মো. খোরশেদ। সে এক শিফটের বিনিময়ে আমাকে দুই হাজার টাকার মতো দেয়। স্বজন পরিবহনের ব্যানারে গাড়িটি চলার জন্য প্রতি মাসে ব্যানারের মালিককে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা দিতে হয়। আর মাসে গাড়ির কিস্তি বাবদ দিতে হয় ৪২ হাজার টাকা। সব মিলে খরচ হয় ৫০ হাজার টাকার মতো।
তিনি আরও বলেন, ছোটবেলা থেকে গাবতলীতে পরিবহনের সঙ্গে জড়িত আছি। সারা জীবনের সঞ্চয়ের টাকা দিয়ে এ গাড়িটি কিস্তিতে কিনেছি। আমার এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে গাবতলীতে থাকি। কিস্তির টাকা আর পরিবার চালাতে আমাকে নিয়মিত হিমসিম খেতে হয়। আদালতের দেয়া ক্ষতিপূরণের টাকা আমি কিভাবে দেব। তিনি আরও বলেন, স্বজন পরিবহনের ব্যানারে রোডে চলে ৪০টি গাড়ি। ৪০টি গাড়ির মালিক ৪০ জন। অপরদিকে বিআরটিসি বাসটি জিম্মায় নেয়ার আবেদনকারী আজাহার আলী বলেন, ক্ষতিপূরণের টাকা দেয়ার বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানেন। আমি গাড়ি জিম্মায় নিতে এসেছি। আমি এ বিষয়ে কিছু জানি না।
এর আগে মঙ্গলবার হাইকোর্টের বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও বিচারপতি একেএম জহিরুল হকের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ রাজীব হাসানের পরিবারকে এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আগামী এক মাসের মধ্যে বিআরটিসি ও স্বজন পরিবহনকে ক্ষতিপূরণের অর্ধেক (৫০ লাখ) টাকা পরিশোধের নির্দেশ দেয়া হয়। এছাড়া রাজীবের খালা জাহানার পারভীন এবং রাজীবের গ্রামের বাড়ি বাউফলের সাবেক চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদের ছেলে কাস্টমস কর্মকর্তা ওমর ফারুকের নামে সোনালী ব্যাংকের মতিঝিল শাখায় একটি যৌথ অ্যাকাউন্ট খুলতে বলা হয়েছে। এ বিষয়ে অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল এবং পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী ২৫ জুন শুনানির দিন ঠিক করেন আদালত।
আদালতে রিটকারী আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল শুনানি করেন। অন্যদিকে বিআরটিসির পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার মো.মনিরুজ্জামান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অরবিন্দ কুমার রায়। আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল জানান, দুই বাসের পাল্লায় না ফেরার দেশে চলে যাওয়া কলেজ ছাত্র রাজীবের দুই ভাইকে এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে বিআরটিসি এবং স্বজন পরিবহনের মালিককে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। ওই এক কোটি টাকার অর্ধেক, অর্থাৎ ৫০ লাখ টাকা পরিশোধের জন্য দুই পরিবহনের মালিককে এক মাসের সময় দিয়েছে আদালত।
তিনি জানান, রাজীবের খালা জাহানারা পারভীন এবং রাজীবের গ্রামের বাড়ি বাউফলের সাবেক চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদের ছেলে কাস্টমস কর্মকর্তা ওমর ফারুকের নামে সোনালী ব্যাংকের মতিঝিল শাখায় একটি যৌথ অ্যাকাউন্ট খোলা হবে। বিআরটিসি এবং স্বজন পরিবহনের মালিককে এক মাসের মধ্যে ২৫ লাখ টাকা করে মোট ৫০ লাখ টাকা জমা দিতে হবে ওই অ্যাকাউন্টে। টাকা জমা দেয়ার বিষয়টি ২৫ জুনের মধ্যে আদালতকে লিখিতভাবে জানাতে হবে। রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ২৫ জুন বিষয়টি আবার আদালতে এলে তখনই বাকি ৫০ লাখ টাকার বিষয়ে নির্দেশনা দিতে পারে আদালত।
উল্লেখ্য, গত ৩ এপ্রিল দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারের সার্ক ফোয়ারার কাছে বিআরটিসি’র একটি দ্বিতল বাসের পেছনের ফটকে দাঁড়িয়ে গন্তব্যের উদ্দেশে যাচ্ছিলেন সরকারি তিতুমীর কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রাজীব হোসেন। বাসটি হোটেল সোনারগাঁওয়ের বিপরীতে পান্থকুঞ্জ পার্কের সামনে পৌঁছালে হঠাৎ পেছন থেকে স্বজন পরিবহনের একটি বাস বিআরটিসি’র বাসটিকে ঘেঁষে অতিক্রম করে।
এ সময় দুই বাসের প্রবল চাপে গাড়ির পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা রাজীবের ডান হাত কনুইয়ের ওপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এ ঘটনায় সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। এতে তার মাথায়ও প্রচণ্ড আঘাত লাগে। দুর্ঘটনার পর তাকে প্রথমে শমরিতা হাসপাতালে ও পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। ১০ এপ্রিল ভোর পৌনে ৪টায় অজ্ঞান হয়ে পড়েন রাজীব। এরপর ওই দিন সকাল ৮টায় তাকে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়। ১৭ এপ্রিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় রাজীব মারা যান।
৩ এপ্রিল রাজীব বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় পেনাল কোডের ২৭৯/৩৩৮- এর ক ধারায় মামলা দায়ের করেন। ২৭৯ ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি তিন বছর ও ৩৩৮ ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি দুই বছরের জেল। মামলার পরই বিআরটিসি বাসের চালক ওয়াহিদ ও স্বজন পরিবহনের বাসের চালক মো. খোরশেদকে গ্রেফতার করে পুলিশ। বর্তমানে তারা কারাগারে আটক রয়েছেন। ২৩ এপ্রিল ঢাকা মহানগর হাকিম গোলাম নবীর আদালতে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা শাহবাগ থানার উপ-পরিদর্শক আফতাব আলী মূল মামলার ধারার সঙ্গে পেনাল কোডের ৩০৪ এর খ সংযোজন করার অনুমতি চাইলে আদালত তা মঞ্জুর করেন, যার সর্বোচ্চ শাস্তি তিন বছরের কারাদণ্ড।