ইভিএম ব্যবহারে আরপিও সংশোধনের সিদ্ধান্ত ইসির

লেখক:
প্রকাশ: ৬ years ago

নির্বাচন কমিশন ইভিএমে (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) ভোট গ্রহণের বিধান রেখে আরপিও সংশোধনের প্রস্তাব করেছে। কয়েক দিনের মধ্যে প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। মন্ত্রণালয়ের প্রক্রিয়া অনুয়ায়ী তা সংসদে উত্থাপন করা হবে। আইন পাস হলে সারাদেশে ইভিএম প্রদর্শনী হবে। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনা হবে। আজ বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা এসব কথা বলেন।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনীর প্রস্তাব চূড়ান্ত করতে অনুষ্ঠিত আজকের বৈঠক শেষে এসব কথা বলেন সিইসি।
সভার সিদ্ধান্ত সাংবাদিকদের জানানোর সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা বলেছেন, আগামী ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় একাদশ সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত এখনও নেননি তারা।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভালো ফল পেয়েছি। যাতে সংসদ নির্বাচন তা ব্যবহার করা যায় সে প্রস্তুতি নিতেই আমরা আইন সংশোধনের প্রস্তাব করেছি। নির্বাচনে যে ইভিএম ব্যবহার করা হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি। স্টেক হোল্ডাররা (সংশ্লিষ্টরা) সম্মতি দিলে ইভিএম ব্যবহার করা হবে। এ বিষয়ে কমশিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সুতরাং ইভিমএম ব্যবহার হবে সে সিদ্ধান্ত নেইনি। তবে আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছে।
কে এম নুরুল হুদা বলেন, মাহবুল তালুকদারের নোট অব ডিসেন্ট সম্পের্ক ওনার ভিন্নমত থাকতে পারে এটা গণতান্ত্রিক পদ্ধতি।

আজ বেলা ১১টার দিকে এই বৈঠক শুরু হয়। তবে বৈঠক শুরুর আধা ঘণ্টার মধ্যে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার সভা বর্জন করেন। তিনি ইভিএম কেনার বিষয়ে আপত্তি (নোট অব ডিসেন্ট) জানান। সিইসির ঘোষণার পর গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে মাহবুব তালুকদার আবার বলেন, ‘আমি এটার (ইভিএম ব্যবহারের) বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছি। আমি মোটেই চাই না আগামী সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের জন্য আরপিও সংশোধন হোক। এখন ওনারা বসে বসে আরপিও সংশোধন করতে থাকবেন আর আমি সেখানে নোট অব ডিসেন্ট দেওয়ার পর মূর্তির মতো বসে থাকব, এটা আমার কাছে যথাযথ মনে হয়নি।’

মাহবুব তালুকদার আরও বলেন, ‘ওনারা ওনাদের কাজ করুন আমি আমার কাজ করি।’
ইভিএম নিয়ে খোদ নির্বাচন কমিশনের মধ্যে এই মতভিন্নতা যেমন রয়েছে তেমনি রাজনৈতিক অঙ্গনেও এ নিয়ে বিতর্ক চরমে। আর এই রাজনৈতিক বিতর্কের মধ্যেই আরপিও সংশোধনের থেমে যাওয়া উদ্যোগ হঠাৎ করে সচল করে ইসি। আরপিও সংশোধনী প্রস্তাব চূড়ান্ত করতে আজ বৈঠকে বসে।

জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার মাস দুয়েক আগে ইভিএমের জন্য আরপিও সংশোধনে ইসির এই তোড়জোড় নিয়ে রাজনৈতিক মহলে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। বড় পরিসরে ব্যবহার করার মতো সক্ষমতা ও দক্ষ জনবল তৈরি না করেই দেড় লাখ ইভিএম কেনা এবং আইন সংশোধনের উদ্যোগ শুধু কেনাকাটার জন্য কি না, সে প্রশ্নও সামনে এসেছে।

বিএনপি ইসির এই উদ্যোগে সমালোচনায় মুখর হয়েছে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঢাকায় আজ বলেছেন, আওয়ামী লীগ এখন জনগণের ওপর আস্থা হারিয়ে যন্ত্রের ওপর ভর করছে। জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের পরিকল্পনা সরকার ও নির্বাচন কমিশনের একটি অশুভ পার্টনারশিপ।

আজ বিএনপির চেয়ারপারসনের গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এসব কথা বলেন। সংবাদ সম্মেলন শেষে ম্যাট বিশপ নামের একজন ইভিএম বিশেষজ্ঞের সঙ্গে স্কাইপে কথা বলেন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ। এই বিশেষজ্ঞ ইভিএমের বিভিন্ন ত্রুটি, আস্থার সংকট ও ঝুঁকির বিষয় তুলে ধরেন।

মির্জা ফখরুল অভিযোগ করেন, নির্বাচন কমিশন ও সরকার জনমতকে উপেক্ষা করে জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আরপিও সংশোধনের মাধ্যমে ভোট জালিয়াতি করতে নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের অপকৌশল হাতে নেওয়া হয়েছে।

গতকাল বুধবার রাজধানীতে এক সভায় বাম গণতান্ত্রিক জোটও ইভিএম ব্যবহারের বিরোধিতা করে। জাতীয় নির্বাচনে ইসির ইভিএম ব্যবহারের তোড়জোড় নিয়ে জোটের সমন্বয়ক সাইফুল হক বলেন, যেখানে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ইভিএমের বিপক্ষে, সেখানে ইসির এ ধরনের পদক্ষেপ সন্দেহজনক। তিনি বলেন, মানুষের মনে এখন সন্দেহ জাগছে, সরকারি দলকে বাড়তি কোনো সুবিধা দিতে ডিজিটাল কারচুপির জন্য এই ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

ইভিএম নিয়ে বিরোধী দলগুলো বিরুদ্ধাচারন করলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ অবশ্য বলেছে, তারা নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত মেনে নেবে। আজ গাজীপুরে সড়ক পরিদর্শন করতে গিয়ে দলটির সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, পৃথিবীর অনেক দেশই সময় এবং খরচ সাশ্রয়ের লক্ষ্যে ইভিএম প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। তাই আওয়ামী লীগ ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে। তবে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত সরকার মেনে নেবে।

গত বছর অংশীজনদের সঙ্গে ইসির সংলাপে আলোচিত বিষয় ছিল ইভিএম। ৩৯টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল সংলাপে অংশ নিয়েছিল। ২৩টি দল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম নিয়ে নিজেদের মতামত জানিয়েছিল। এর মধ্যে বিএনপিসহ ১২টি দল ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে মত দেয়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ সাতটি দল ইভিএমের পক্ষে। তিনটি দল পরীক্ষামূলক ও আংশিকভাবে এবং একটি দল শর্ত সাপেক্ষে ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে মত দিয়েছিল।

ইসি এত দিন বলে এসেছে, সব দল না চাইলে জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে না।
কিন্তু এর মধ্যে দেড় লাখ ইভিএম কেনার জন্য ৩ হাজার ৮২৯ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে ইসি। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ইসিকে ইভিএম সরবরাহ করবে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (বিএমটিএফ)।

‘নির্বাচনব্যবস্থায় অধিকতর স্বচ্ছতা আনয়নের লক্ষ্যে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ক্রয়, সংরক্ষণ ও ব্যবহার’ শীর্ষক পাঁচ বছর মেয়াদি একটি প্রকল্পের অধীনে দেড় লাখ ইভিএম সংগ্রহ করতে চায় ইসি। অবশ্য ১৯ আগস্ট এই প্রকল্প নিয়ে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি।

এই হযবরল অবস্থার মধ্যেই গত জুলাই থেকে ইভিএম আমদানির প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ জন্য ঋণপত্র খুলতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ অনুমোদন নিয়েছে ট্রাস্ট ব্যাংক। চীন, হংকংসহ আরও কয়েকটি দেশ থেকে ইভিএম ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি এনে বিএমটিএফ তা নির্বাচন কমিশনকে সরবরাহ করবে বলে নথিপত্রে উল্লেখ রয়েছে। ইতিমধ্যে ৭৯৩ কোটি ৭৪ লাখ টাকার ঋণপত্র খোলা হয়েছে। যন্ত্রপাতি আমদানিতে মোট ব্যয় হবে ২ হাজার ৬৯৬ কোটি টাকা।