সম্প্রতি করোনার টিকা সরবরাহ নিয়ে আস্ট্রাজেনেকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) মধ্যে বাগযুদ্ধ শুরু হয়েছে। আস্ট্রাজেনেকার দাবি, মার্চের মধ্যে ইইউকে যে ১০ কোটি ডোজ টিকা সরবরাহ করার কথা ছিল তাদের উৎপাদন ব্যবস্থার কারণে তা সম্ভব হবে না। আবার একই প্রতিষ্ঠান একই সময়ের মধ্যে যুক্তরাজ্যকে জানিয়েছে, লন্ডনের যে ১০ কোটি ডোজ টিকা কেনার আদেশ রয়েছে সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে তারা প্রতি সপ্তাহে তারা ২০ লাখ ডোজ টিকার উৎপাদন করতে পারবে। প্রতিষ্ঠানটির এই দ্বিমুখী বক্তব্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে ইইউ।
এর জেরে গত সপ্তাহে ইইউর সঙ্গে স্বাক্ষরিত টিকা কেনার চুক্তিটি ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে প্রথমবারের মতো পড়া হয়েছিল। তবে চুক্তিটি পড়ার সময় দেখা গেছে, এতে অনেক কিছু এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রকৃত অর্থে জনসাধারণের কাছ থেকে লুকিয়ে ফেলা হয়েছে। চুক্তি নিয়ে টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন দেশের সরকারগুলোর কেন এই লুকোচুরি? শুক্রবার নিউ ইয়র্ক টাইমস এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বেশ কিছু বিষয় তুলে ধরেছে। পাঠকদের জন্য তারই সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হলো।
নিউ ইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, বিভিন্ন দেশের সরকার টিকা তৈরির জন্য ফার্মাসিউটিক্যালস প্রতিষ্ঠানগুলোকে শত শত কোটি মার্কিন ডলার দিয়ে সহায়তা করেছে। আবার সেইসব প্রতিষ্ঠান থেকেই শত শত কোটি ডলার দিয়ে টিকা কিনে নিতে হচ্ছে। কিন্তু এই পুরো প্রক্রিয়ার অনেক বড় অংশই গোপন রাখা হচ্ছে। আর এই গোপনীয়তার কারণে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে দায়বদ্ধতার আওতায় আনা মুশকিল হয়ে পড়ছে। এতো গোপনীয়তার পরও সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার নথিপত্র, সরকারি বিবৃতি, সাক্ষাৎকার ও মাঝেমধ্যে ফাঁস হয়ে যাওয়া মন্তব্যের বদৌলতে টিকার কিছু গোপন তথ্য জানা যাচ্ছে। এ পর্যন্ত যেসব কিছু জানা গেছে তার মধ্যে রয়েছে-
টিকা তৈরিতে সহযোগিতা করেছে সরকারগুলো
টিকা উন্নয়ন হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ উদ্যোগ। টিকার কার্যকারিতা প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত এবং সরকারি অনুমোদ না পাওয়ার আগ পর্যন্ত কোনো প্রতিষ্ঠানই এর উৎপাদনে যেতে চায় না। এ কারণেই টিকার উন্নয়নে দীর্ঘ সময় লাগে। এই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ এবং কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস ইনোভেশনসের (সিইপিআই) মতো দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলো সব ঝুঁকি অপসারণে এগিয়ে এসেছিল। উদহারণ হিসেবে বলা যায়, মেরিল্যান্ডভিত্তিক নোভাভ্যাক্সকে ১৬০ কোটি ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। আর সিইপিআই সুদবিহীন ঋণ দিয়েছিল ৪০ কোটি ডলারের।
অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো আরো বেশি সহযোগিতা পেয়েছে। যেমন-মডার্না সরকারি উন্নয়ন প্রযুক্তি ব্যবহারের সুবিধা নিয়েছে এবং টিকা উন্নয়নে ১০০ কোটি ডলার সহায়তা পেয়েছে। বাজারে আসার আগে যুক্তরাষ্ট্র সরকার প্রতিষ্ঠানটিকে এক হাজার ৫০০ কোটি ডলার মূল্যের টিকা কেনার আদেশ দিয়ে রেখেছিল।
তবে প্যাটেন্ট থাকবে কোম্পানিগুলোরই
সরকার ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলো শত শত কোটি ডলার সহায়তা দিলেও টিকা উন্নয়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলো টিকা আবিষ্কারের প্যাটেন্ট তাদের কাছেই রেখে দিয়েছে। এর ফলে কোথায় টিকার উৎপাদন হবে, কী দামে বিক্রি হবে তা এসব প্রতিষ্ঠানই নির্ধারণ করবে। ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা প্যাটেন্টের ক্ষেত্রে ছাড় চেয়েছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য তাদের হয়ে এই প্রস্তাব তুলেছিল, যাতে উন্নয়নশীল দেশগুলো কম দামে টিকা উৎপাদন ও সরবরাহ করতে পারে। কিন্তু এতে বাঁধ সেধেছিল যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ। তাদের মতে, উদ্ভাবনের জীবনীশক্তি হচ্ছে প্যাটেন্ট। তাই এতে ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
পাবলিক সিটিজেন নামে একটি পর্যবেক্ষক গ্রুপের সদস্য জাইন রিজভির মতে, ‘এর মাধ্যমে সরকারগুলো কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছে।’
দামের ভিন্নতা
একই প্রতিষ্ঠান একেক দেশের কাছে টিকা ভিন্ন দাম হাঁকছে। আর দামের এই বিষয়টি পুরোই গোপন রাখা হচ্ছে। সরকারের আলোচক বা ক্রয় মধ্যস্থতাকারীদের ওপর হাত রেখেছে টিকা উৎপাদনকারীরা। ফলে কোন দেশ কী দামে টিকা পাচ্ছে তা অপর দেশ জানতে পারছে না। তবে সম্প্রতি ফাঁস হওয়া নথিতে দেখা গেছে, আস্ট্রাজেনেকার টিকার প্রতি ডোজের জন্য ইউরোপিয়ান কমিশন দিচ্ছে ২ দশমিক ১৯ ডলার করে। অথচ একই প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ আফ্রিকার কাছ থেকে চেয়েছে ৫ দশমিক ২৫ ডলার। আবার ফাইজারের টিকার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের করদাতাদের গুনতে হচ্ছে ১৯ দশমিক ৫০ ডলার। অথচ একই প্রতিষ্ঠান ইউরোপের কাছে ১৪ দশমিক ৭০ ডলারে টিকা বিক্রি করছে। এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্যই করছে না টিকা উৎপাদনকারীরা।
দান ও পুনঃবিক্রি নিয়ন্ত্রিত
জনস্বাস্থ্য পরামর্শকরা ধনী দেশগুলোকে দান কিংবা পুনঃবিক্রির মাধ্যমে দরিদ্র দেশগুলোকে সহযোগিতার আহ্বান জানিয়ে আসছে। তবে এখানেও প্রতিবন্ধকতা দিয়ে রেখেছে টিকা উৎপাদনকারীরা। চুক্তিগুলোতে টিকা তৃতীয় দেশে বিক্রির ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। যেমন ধরুন, কিউর্যভাক্সের সঙ্গে চুক্তির কথা। এই চুক্তিতে পুনঃবিক্রি, রপ্তানি কিংবা দানের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, কোম্পানি কোনো অনুমতি ছাড়া ইউরোপীয় দেশগুলো এই কাজ করতে পারবে না।
যখন আসার তখন আসবে
টিকা কখন আসবে কিংবা কখন সরবরাহ করা হবে এ নিয়ে উৎপাদনকারীদের কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। ইউরোপীয় ইউনিয়ন অবশ্য ইতোমধ্যে এই শর্তের ফল ভুগতে শুরু করেছে। প্রথমে ইউরোপীয় কর্মকর্তারাই চুক্তি গোপন রাখতে চেয়েছিলেন, এখন তারাই চুক্তি প্রকাশের জন্য আস্ট্রাজেনেকাকে চাপ দিচ্ছেন।
টিকা থেকে মুনাফা করছে সরকারগুলো
বেশ কয়েকটি দেশ টিকার উন্নয়ন থেকে মুনাফা কামিয়ে নিচ্ছে। জার্মান টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বায়োএনটেককে ১০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক। সুদ ছাড়াও টিকা বিক্রির মুনাফা থেকে আড়াই কোটি ডলার মুনাফা পাবে ব্যাংকটি। কেবল একটি প্রতিষ্ঠানের কথা প্রকাশ হলেও অন্যগুলোর লেনদেনের বিষয় এখনও প্রকাশিত হয়নি।