আর বাঁশি বাজাবেন না রেফারি আজাদ রহমান

লেখক:
প্রকাশ: ৭ years ago

দুই মেয়ে ফাইরুজ নাওয়া তরঙ্গ ও নুবাইদা আরস তটিনি আজাদ রহমানের কাছে বায়না ধরেছেন তারা বুধবার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে যাবে মোহামেডান-আবাহনীর ম্যাচে। ঘরোয়া ফুটবলে যেখানে দর্শকখরা, সেখানে অষ্টম শ্রেনীর তরঙ্গ আর পঞ্চম শ্রেনীর তটিনির কেন এমন বায়না? দেশসেরা এ দুই দলের ম্যাচ তো এখন অনেক ফুটবল-পিপাসুকেও গ্যালারিতে টানে না।

আসলে তরঙ্গ আর তটিনিকে ফুটবল নয়, টানছেন তার বাবা আজাদ রহমান। ‘বাঁশিওয়ালা বাবা’র বিদায়ী ম্যাচ বলে কথা। তাদের কাছে ‘ফুটবল’ কিংবা ‘মোহামেডান-আবাহনী ম্যাচ’ যে তুচ্ছ। ক্যারিয়ারের শেষ দিনে আজাদ রহমানও বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে নিয়ে আসবেন দুই মেয়ে ও তাদের মাকে।

১৬ বছর আগে ২০০১ সালে বাঁশি হাতে নিয়েছিলেন আজাদ রহমান। দেশে-বিদেশে আর ছোট-বড় মিলিয়ে ৩ হাজারের মতো ম্যাচে বাঁশি বাজিয়েছেন ঢাকার কুর্মিটোলায় বেড়ে ওঠা দেশের অভিজ্ঞ এ রেফারি। নতুনদের জায়গা করে দিতেই ৪৫ বছর বয়সে বাঁশি তুলে রাখার সিদ্ধান্ত এএফসির সাবেক এ এলিট রেফারির। আর বিদায়ের জন্য তিনি বেছে নিয়েছেন মোহামেডান ও আবাহনীর মধ্যেকার বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের ফিরতি ম্যাচটি।

এ ম্যাচে তিনি অবশ্য বাঁশি বাজাবেন না। ম্যাচ শুরুর আগে দুই দলের অধিনায়ককে নিয়ে টস করবেন। শেষ বাঁশি যে মাসখানেক আগেই বাজিয়েছেন আজাদ রহমান। ২০০১ সালে আদমজী ও মাতুয়াইলের মধ্যেকার তৃতীয় বিভাগের ম্যাচ পরিচালনা দিয়ে শুরু, শেষটা হয়েছে গত ১৪ অক্টোবর ‘মোহামেডান-ব্রাদার্স’ ম্যাচ দিয়ে। বুধবার যে তার শুধুই বিদায়ের আনুষ্ঠানিকতা।

Azad

ফুটবল রেফারি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেলেও এ কাজটি তিনি কখনই করতে চাননি। ফুটবলের চেয়ে আজাদ রহমানকে ক্রীড়াঙ্গনের মানুষ বেশি চিনতেন হ্যান্ডবল ও বাস্কেটবল খেলোয়াড় হিসেবে। দুটি খেলাই সমানতালে চালিয়েছেন, হ্যান্ডবলে জাতীয় দলের জার্সিও গায়ে উঠেছে তার। এ দুটি খেলাতেই কাটিয়েছেন ২৬ বছর। আর ফুটবলার হিসেবে তার দৌঁড়টা সীমাবদ্ধ ছিল পাইওনিয়ার লিগে।

ফুটবলের বাঁশিটা তার হাতে উঠেছে নাটকীয়ভাবেই। রেফারি হওয়ার গল্পের সেই শুরুটা জানা যাক তার কাছ থেকেই। ‘ফুটবলের রেফারি হওয়ার কোনো ইচ্ছে আমার ছিল না। কখনো মাথায়ও আসেনি। ২০০০ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা বিভাগের ফিজিক্যাল ইনস্টট্রাক্টর হিসেবে চাকরিতে যোগ দেই। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্ত:বিভাগীয় বাস্কেটবল প্রতিযোগিতার একটি খেলা পরিচালনা করছিলাম। খেলা শেষে শারীরিক শিক্ষা বিভাগের তখনকার ডেপুটি ডাইরেক্টর আবদুল খালেক আমাকে ডেকে বললেন, তোমার বাঁশি বাজানো দেখলাম। তুমি ফুটবলে আরো ভালো করবে। তখন থেকেই শুরু’-মঙ্গলবার বলছিলেন আজাদ রহমান।

শুরুর গল্পটা অবশ্য ওখানেই শেষ নয়। ফুটবলের রেফারি হওয়ার পেছনে আবদুল খালেকের অবদানের প্রসঙ্গটি বারবার টেনে এএফসির এলিট প্যানেলের সাবেক এ রেফারি বলছিলেন, ‘খালেক ভাইয়ের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ফুটবল রেফারি কিভাবে হবো? তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আয়োজিত একটি রেফারিং কোর্সে অংশ নেয়ার সুযোগ করে দেন আমাকে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাটা সেখান থেকেই শুরু।’

কেবল ঘরোয়াই নয়, আন্তর্জাতিক ম্যাচেও আরো অনেক উপরে ওঠার মতো সম্ভাবনাও তার ছিল। কিন্তু শারীরিক সমস্যার কারণে এএফসির এলিট প্যানেলে ঢুকেও থাকতে পারেননি ২ বছরের বেশি। দীর্ঘ ১৬ বছরের ক্যারিয়ারের ইতি টানার আগের সন্ধ্যায় এই একটি অতৃপ্তির কথাই বেড়িয়ে আসলো তার কণ্ঠ থেকে। যে কারণে ২০১০ সালে মিয়ানমারে এএফসি কাপের তিনটি ম্যাচের (তাজিকিস্তান-পাকিস্তান, তাজিকিস্তান-শ্রীলংকা ও শ্রীলংকা-পাকিস্তান) মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার।

আজাদ রহমান যখন বাঁশি হাতে নিয়েছেন তখন ঘরোয়া ফুটবল অতীতের কঙ্কাল। আশির দশকের মতো মোহামেডান-আবাহনীর আগুনে ম্যাচ পরিচালনা করার সুযোগ হয়নি তার। তবে প্রায় দেড় যুগের ক্যারিয়ারে ১২ টি মোহামেডান-আবাহনী ম্যাচে বাঁশি বাজিয়েছেন আজাদ রহমান।

Azad

ক্যারিয়ারের একটি সাহসী সিদ্ধান্তের অভিজ্ঞতার কথাও বললেন আজাদ রহমান, ‘মোহামেডান-আবাহনী ফেডারেশন কাপের ফাইনাল ম্যাচে আমি ছিলাম সকহারী রেফারি। বাঁশি ছিল মনসুর আজাদ ভাইয়ের হাতে। আবাহনীর বিরুদ্ধে মোহামেডানের করা একটি গোল বাতিল করেছিলাম। কারণ আবাহনীর গোলরক্ষকের দৃষ্টিতে বাধা দিয়েছিলেন মোহামেডানের জাহিদ। পরে ভিডিওতে প্রমাণিত হয়েছিল বাতিলের জন্য আমার পতাকা উত্তোলণ সঠিকই ছিল।’

রেফারি হিসেবে সাহসিকতা তিনি দেখিয়েছিলেন ক্যারিয়ারের প্রথম ম্যাচেই। ২০০১ সালে আদমজী ও মাতুয়াইলের মধ্যেকার তৃতীয় বিভাগের ম্যাচে প্রথম বাঁশি হাতেই তিনি পকেট থেকে লালকার্ড বের করে উঁচিয়ে ধরেছিলেন ৪ বার। যার মধ্যে তিনটি লাল কার্ড পেয়েছিলেন আদমজী ও একটি মাতুয়াইল দলের খেলোয়াড়।

২০০৬ সালে ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে একটি প্রদর্শনী ম্যাচে খেলেছিলেন ফরাসি কিংবদন্তী ফুটবলার জিনেদিন জিদান। ওই ম্যাচটিও পরিচলনা করেছিলেন আজাদ রহমান। রেফারি মানেই বাঁশিওয়ালা। তো ১৬ বছরের ক্যারিয়ারে কয়টি বাঁশি ব্যবহার করেছেন আজাদ?

‘পুরো ক্যারিয়ারে ৬টি বাঁশি ব্যবহার করেছি। শুরু করেছিলাস ফক্স-ফরটি ব্র্যান্ডের একটি বাঁশি দিয়ে, শেষ করছি একমি ব্র্যান্ড দিয়ে। ডাবলনোজের এ বাঁশিটি অনেক বড়। প্রথমটি আমাকে গিফট দিয়েছিলেন মনির ভাই (প্রয়াত মনিরুল ইসলাম)। পরে একই ব্র্যান্ডের বাঁশি আমি থাইল্যান্ড থেকে এনেছিলাম’-বাঁশির গল্প বলছিলেন বাঁশিওয়ালা আজাদ রহমান।

বাংলাদেশের রেফারিরা সম্ভাবনার দুয়ারে দাঁড়িয়ে আছে বলেই তিনি নতুন রেফারি তৈরির কাজ করতে চান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা বিভাগের সহকারী পরিচালক হিসেবে চাকরিটি আছে আরো ১৭ বছর। বুধবার আনুষ্ঠানিক অবসরের পর খারাপ নিশ্চয় লাগবে তার।

‘আসলে বাঁশি হাতে মাঠে নামলে একটা অন্যরকম ফ্লেভার পেতাম। কখনো কখনো গায়ের পশমও দাঁড়িয়ে যেতো। ফুটবল ম্যাচের প্রতি মায়া ও যে টানটা তৈরি হয়েছে, সেটাই মিস করবো’-বলছিলেন আজাদ রহমান।