সাক্ষাতে দেখা হয়নি কখনও। কথাও হয়নি। তবুও এত ভালোবাসা! এত আবেগ! টেলিভিশনের পর্দা আর পত্রিকার পাতা থেকে হৃদয়ের পাতায় ঠাঁই দিয়েছেন সদ্য প্রয়াত মেয়র আনিসুল হককে চট্টগ্রামের এক মা। আনিসুল হকের মৃত্যুর পর বেদনা জানাতে চট্টগ্রাম থেকে ছেলেকে ঢাকায় চিঠি পাঠিয়েন সেই মা।
বুধবার সেই চিঠি প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের কুলখানির অনুষ্ঠানে পড়ে শোনান তার ছোট ভাই তৌহিদুল হক। এদিন বাদ আসর রাজধানীর গুলশানে আজাদ মসজিদে তৌহিদুল হক উপস্থিত স্বজনদের ঘটনাটি জানান।
তৌহিদুল হক বলেন, ‘তিনদিন আগে কবর জিয়ারত করতে গিয়েছিলাম। তখন পেছন থেকে একটি ছেলে ডাক দিয়ে আমাদের বলে- সে চট্টগ্রাম থেকে এসেছে। তার মা পাঠিয়েছে আনিসুল হকের কবর জিয়ারত করতে। তার মা অসুস্থ থাকার কারণে আসতে পারেননি। তিনি আনিসুল হকের পরিবারকে দেয়ার জন্য একটি চিঠিও দিয়েছেন।
চিটির খামে লেখা- রেজাউল করিম, দক্ষিণ মধ্যম, হালিশহর, চট্টগ্রাম। চিঠিটি তার মা নিজের হাতেই লিখেছেন। চিঠিটি পড়ছি জানিয়ে তৌহিদুল হক হুবহু পাঠ করেন।
চিঠিতে যা লেখা-
‘প্রিয় আনিসুল হক। জানি না কেমন আছেন। তবে ভালো আছেন বলে মনে হচ্ছে। কারণ মানুষের দোয়া তো সবসময়ই আছে। আচ্ছা আমাদের সঙ্গে তো আপনার কোনো সম্পর্ক নেই। দেখা পর্যন্ত হয়নি। তাহলে আপনার জন্য এ অনুভূতি কেন। আসলে একজন মানুষকে ভালো না লাগার অনেক কারণ থাকতে পারে। কিন্তু কী কারণে যে ভালো লাগে বা মানুষকে ভালোবাসে তা হয়তো মানুষের পক্ষে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
আপনি মেয়র হওয়ার অনেক আগে থেকেই আপনার ভক্ত আমরা। আপনি মেয়রের দায়িত্ব পাওয়ার পর যে স্বপ্ন ঢাকা শহরের সাধারণ মানুষ ও গরিব জনগোষ্ঠী দেখেছিল তা হয়তো আর দেখা হবে না। কারণ আনিসুল হকরা বারবার জন্মায় না। তারা হঠাৎ আসেন, আমাদের মনে জায়গা করে নেন, আবার হঠাৎ চলে যান। আর আমাদের মনে হয়, আল্লাহ আমাদের জন্য তার কোনো ফেরেস্তা পাঠিয়েছেন।
শৈশবে ও কৈশোরে আপনাকে দেখেছিলাম বিটিভির পর্দায়। যৌবনে আপনার মুখ এঁকেছিলাম আমাদের ডায়েরির পাতায়। হঠাৎ মুছে যাবে ভাবতেও পারিনি। আমার বন্ধুরা প্রায় সবসময় বলতো, কষ্ট যদি সাধারণ মানুষের হাতে থাকতো তাহলে মানুষের কোনো কষ্টই থাকতো না। জানি আমার কথাগুলো পৌঁছাবে না আপনার কাছে। এটাই জানি আমাদের ভালোবাসার অনুভূতি কোনোদিন ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। শুধু বলব, উই লাভ ইউ মোর দ্যান আওয়ার লাইফ। ভালো থাকবেন স্যার।’
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের কুলখানিতে উপস্থিত ছিলেন আত্মীয়-স্বজন, শুভানুধ্যায়ীসহ সাধারণ মানুষ। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন আনিসুল হকের স্ত্রী রুবানা হক, ছেলে নাভিদুল হক, দুই মেয়ে ওয়ামিক উমায়রা হক ও তানিশা ফারিয়াম্যান হক, নাতনি, ছোট ভাই সেনাপ্রধান জেনারেল আবু বেলাল মোহাম্মদ শফিউল হক।
উল্লেখ্য, ২৯ জুলাই ব্যক্তিগত সফরে সপরিবারে যুক্তরাজ্যে যান মেয়র আনিসুল হক। অসুস্থ হয়ে পড়লে ১৩ আগস্ট তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তার মস্তিষ্কের প্রদাহজনিত রোগ ‘সেরিব্রাল ভাস্কুলাইটিস’ শনাক্ত করেন চিকিৎসকরা। এরপর তাকে দীর্ঘদিন আইসিইউতে চিকিৎসা দেয়া হয়। একপর্যায়ে মেয়রের শারীরিক পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হওয়ায় তার কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র খুলে নেয়া হয়।
পরবর্তীতে রক্তে সংক্রমণ ধরা পড়ায় তাকে আবার আইসিইউতে নেয়া হয়। বাংলাদেশ সময় গত বৃহস্পতিবার রাতে মারা যান আনিসুল হক। শনিবার বিকেলে বনানী কবরস্থানে ছোট ছেলে শারাফুল হকের কবরে দাফন সম্পন্ন হয় তার।